Spread the love

নেতাজী ও এক উত্তরহীন প্রশ্ন,

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী

      কালের নিয়মে পার্থিব দেহ একটা সময় না ফেরার দেশে চলে গেলেও মহামানবদের মৃত্যু হয়না। তাঁরা চিরকাল মানুষের হৃদয়েই থেকে যান। কিন্তু ইনি এমন একজন মহামানব যাঁর জন্ম আছে কিন্তু স্বাধীনতার পঁচাত্তর-তম বছর পার হওয়ার পরেও জানা যায়না বা রাষ্ট্র নায়কেরা দেশবাসীকে জানান না তাদের সবার প্রিয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কোথায় আছেন? পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছেনা আদৌ সেটা জানানো হবে।

           ১৯০৮ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে যান ক্ষুদিরাম বসু। স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের যুব সমাজ। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। রাজনীতির মঞ্চে প্রবেশ ঘটে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর। তার আগেই দৃঢ়চেতা নেতাজীর দৃঢ়তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেছে ইংরেজদের। ভারতীয়দের অপমান করার জন্য জনৈক ইংরেজ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা আই.সি.এস এ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ঘৃণাভরে ইংরেজদের অধীনে চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিপ্লবী তরুণদের স্বপ্নের কারিগর সুভাষ 'তরুণের স্বপ্ন' নিয়ে কার্যত ইংরেজ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিলেন। তার আগে অবশ্য কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবং আন্দোলনের পথ নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে মতবিরোধ ঘটে গেছে। এরপর গৃহ তথা দেশত্যাগ, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সাতটি দেশের স্বীকৃতি, আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন, কোহিমা দখল এইসব কাহিনী সবার জানা। কিন্তু পরের ইতিহাস অন্ধকারে ঢাকা। রটিয়ে দেওয়া হয় তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়েছে। ঘটনা বা রটনা যাইহোক না কেন স্বাধীনতার পঁচাত্তর-তম বছরেও কোনো এক অজানা কারণে আজও সেই অন্ধকারের কালো মেঘ চিরে চরম সত্যটা বেড়িয়ে এলনা। অথচ 'আই ওয়াস' করার জন্য একের পর তদন্ত কমিশন বসেছে, অর্থের অপচয় হয়েছে। কিন্তু ভারতবাসী জানতে পারলনা তাদের প্রিয় নেতার কি হলো? 

      দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন দেশের  শাসনভার পায় কংগ্রেস। প্রধানমন্ত্রী হন জওহরলাল নেহরু। রটিয়ে দেওয়া নিজের আসন কণ্টকমুক্ত করার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে নাকি ইংরেজদের চুক্তি হয় নেতাজী দেশে ফিরলে তাকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিতে হবে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে মানতেই হবে ইংরেজরাও তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলনা। তাহলে তিনি গেলেন কোথায়? ইংরেজদের কাছে মুচলেকা দেওয়া নেতাকে বীরের সম্মান দিয়ে মাতামাতি করব, নিজেই নিজেকে 'ভারতরত্ন' উপাধি দিয়ে গর্ববোধ করব অথচ যাকে নিয়ে সত্যিকারের গর্ব করা যায় তার ব্যাপারে নীরব থাকাকে হিরন্ময় বলে মনে করা ঠিক নয়। 

         নেতাজীর বিষয়ে কংগ্রেস তথা নেহরু পরিবারের হয়তো বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু কংগ্রেস তথা নেহরু পরিবারের বাইরেও অনেকেই প্রধানমন্ত্রী বা বিভিন্ন রাজ্যের বিশেষ করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কেন তারা নেতাজীর রহস্য উন্মোচনের বিষয়ে সরব না হয়ে নীরব থেকে গেছেন? তাহলে কি ধরে নিতে হবে নেতাজীকে নিয়ে ব্যবসা বা আবেগ সৃষ্টি করার ব্যাপারে তাদের যতটা আগ্রহ রহস্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে তার ছিটেফোটাও নাই? এতো চরম লজ্জার। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তো কংগ্রেস মুক্ত ভারতের কথা বলেন। তাহলে এক্ষেত্রে তিনিই বা চুপ কেন? তাহলে কি রহস্য অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে? কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন? অবশ্য তার অন্ধ ভক্তরা দাবি করতে পারে তিনি নেতাজী সংক্রান্ত কিছু নথি প্রকাশ করেছেন। যদিও নেতাজী গবেষকদের কাছে সেগুলো বহুচর্চিত ও মূল্যহীন । অনেকের বক্তব্য যেহেতু মমতা ব্যানার্জ্জী তার আগেই রাজ্যের হাতে থাকা বেশ কিছু নথি প্রকাশ করেছেন সেই চাপেই তিনি নাকি মূল্যহীন নথি প্রকাশ করেছেন। এখন আবার দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন - ইণ্ডিয়ান গেটে নেতাজীর একটি গ্রানাইটের মূর্তি স্হাপন করা হবে। খুবই ভাল কথা। এই রাজ্য তথা দেশ, এমনকি বিদেশের অনেক জায়গায় নেতাজীর অসংখ্য মূর্তি আছে। নেতাজী ভক্ত ও নেতাজী প্রিয় ভারতবাসীর কাছে সেটা হয়তো একটা অতিরিক্ত নেতাজীর মূর্তির সংখ্যা হবে এবং রাজনীতিবিদদের কাছে হবে আলোচ্য বিতর্কের বিষয়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও আসল রহস্য চাপা পড়ে থাকবে। অথচ এই রহস্য উন্মোচনের দাবি প্রতিটি ভারতবাসী দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে।

       এভাবেই দাবি, পাল্টা দাবি, কংগ্রেসের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে  তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার পর পঁচাত্তর বছর কেটে গেল। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পালিত হবে নেতাজীর একশ পঁচিশ তম জন্ম দিবস। গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে নেতারা বড় বড় কথা বলবে। কিন্তু রহস্যটা রহস্যই থেকে যাবে। অতীত প্রজন্মের মত বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মও জানতে পারবেনা সত্যিই কি ঘটেছিল। এভাবেই বছরের পর বছর পেরিয়ে যাবে। রহস্য আর সামনে আসবেনা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দোহাই দিয়ে একদিন বলে দেওয়া হবে 'নেতাজী ক্লোজড চ্যাপ্টার'। রাজনীতির কারবারি রাজনীতিবিদদের কাছে তিনিই হয়তো রাজনীতি ব্যবসার বড় মূলধন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *