Spread the love

, একা একা বড় একা লাগে

সুবল সরদার,

স্মৃতিকাতর পৃথিবীতে স্মৃতির সাগরের ডুবে হয়তো কোন একদিন মারা যাব। বাবার করুন অসহায় অস্পস্ট মুখটা বড় বেদনাময় করে তোলে। যখন আমার খুব দুঃখ হয়,কষ্ট পাই, বাবার কথা খুব মনে পড়ে। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন এটা আমার খুব মনে আছে। আমি খুব শৈশবে বাবাকে হারাই। মা যখন ফ্যাল ফ্যাল করে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, দেখে আমার খুব কষ্ট হয়। কোভিডের মাঝে দুটো দাদা চলে যায়। মেজদা পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। সকালের ওই প্রাতঃভ্রমণ তার শেষ ভ্রমণ। ফিরে তার নিথর দেহ। কেউ কী স্থির থাকতে পারে। মায়ের কী অসহ্য যন্ত্রণা। তার কিছুদিন পরে বড়দার স্ট্রোকে মৃত্যু । আস্তে আস্তে বাড়ি ফাঁকা হচ্ছে । লাইনে আমি এখন একা আছি। তাই কোন চাপ নেই। বোনের কান্না। দিদির চোখের জল ‌। যখন চোখের উপরে ভাসে সব কেমন গোলমাল করে দেয়। আমি যখন পিজি হাসপাতালের ভর্তি ছিলাম,যখন আমার হার্টের জল জমে সে কী কষ্ট। তখন শুধু ছোটো ছেলেটা ছাড়া আর কারোর কথা মনে পড়ে না। শুধু মনে হয়তো সে কী আমার মতো অনাথ হবে। যন্ত্রনার থেকে এই যন্ত্রণা আরো বেশী যন্ত্রণা দিতো । ভগবানের অশেষ কৃপায় বেঁচে গেছি । এখনো টিকে আছি। তবে শরীরের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ভরা যৌবন থেকে একেবারে বয়স্ক। কালো থেকে পাকা চুলে। এখন কপালে সিনিয়র সিটিজেন এর তকমা জুটেছে। ষাট বছরের জন্যে আমাকে আর অপেক্ষা করতে হয় নি ,খুব সহজে জুটে গেছে। আমার মেয়ে যখন ছোট ছিল, তখন তার দাঁত দু একটা পড়েছে, যখন লোডশেডিং হতো যখন রাতে আমার পাশে বিছানায় শুয়ে থাকতো, বলতো ‘বা বা হাবা করো’। হাত পাখার বাতাস করতে করতে কখনো সে ঘুমিয়ে পড়তো। কারেন্ট আসতো আমিও কখনো ঘুমিয়ে পড়তাম। সে এখন বড় হয়েছে। এখন সে ল ইয়ার। এখন আমার মেয়ে সৌমী নয় । আমি এখন সৌমীর বাবা এই পরিচয়ে পাড়াতে পরিচিত। খুব ভালোলাগে। আমার বউ তাকে নিয়ে পয়লা বৈশাখের কেনাকাটা করতে যাবে । যাবে বারুইপুর রাধেশ্যামে। সেখানে নাকি ভালো জামাকাপড় পাওয়া যায় । কোয়ান্টিটি এবং কোয়ালিটি দুটোই ভালো । কোয়ালিটি ভালো হলে দাম তো চড়া হবে। তার চাই একটা কালো ব্লেজার , একটা সাদা কুর্তি , দুটো আন্ডারওয়ার । ভাবি তার পুতুল খেলার প্রিয় কাপড়গুলো এখন গেল কোথায় ! বউ কিনবে একটা ছাপা শাড়ি। ছেলে টয়েলভ এ পরীক্ষা দিল। সে এখন দার্জিলিং এ বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরছে । এখন আমরা তিন জনে । মা পুরানো বাড়িতে । বড় বৌদির কাছে। সুখী সংসারে আমি কেন একা ভেবে পাই না । কেন এতো অসহায় লাগে বুঝতে পারি না। এলোমেলো ঝোড়ো বাতাসের মতো সব কেমন এলোমেলো করে দেয় ! কখনো কলেজের কথা মনে পড়ে। আমার হৃদয় খুলে যায় । একরাশ মুখে ভেসে ওঠে। সুলেখা,কৃষ্ণা মানসী,ইলা,মিহির। নুরুজ্জামান সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতো। কতো মুখ । রুবির সেই গান আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও আমার প্রাণে। তার আগুনের স্পর্শে মনের বনে দহন ধরে। নির্জনতা ভঙ্গ করে বৈশাখের বাতাসে কোকিলের মতো সে সুর তোলে। সে এখন প্রাণ ছুঁয়ে হৃদয়ে চিরস্থায়ী বাসা বেঁধেছে। ইস! কখনো যদি তাদের সঙ্গে একবার দেখা হয় ! স্মৃতিগুলো কেবল স্মৃতি হয়ে থাকে। বাবা মা, ভাই বোন ,বউ , ছেলে মেয়ে এরা কারা। কেন তারা আমাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়ায়। সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে দেখলাম মেজদা কাঁদাতে কাঁদতে বলছে ভাই আমি তোর সঙ্গে বাড়ি যাব ‌ । পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কখনো ছায়া হয়ে সে মিলিয়ে গেল । এ কী শুধু স্বপ্ন! কেন যে ভুলতে পারি না । কেন মিছে স্মৃতির পিছনে ছুটে মরি ভেবে পাই না। সামনের দিকে হেঁটে চলা মানে জীবন। আমি কেন পিছনের দিকে হেঁটে চলেছি। আমার জীবন কী প্রাণহারা ? আমি কী কেবল বেঁচে আছি? তাই আমি একা? একা একা বড় একা লাগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *