Spread the love

হ-য-ব-র-ল (প্রথম পর্ব),
দেবস্মিতা রায় দাস

 গল্পের নামটা শুনে সুকুমার রায়ের গল্পের মতোন মনে হলেও এটা হল এই আমাদেরই মতোন সাধারণ পাঁচটা মেয়ের গল্প। তাদেরই নামের আদ্যক্ষর এখানে নেওয়া হয়েছে। যথাক্রমে হেনা, যূথিকা, বৃষ্টি, রঞ্জনা, লীনা। প্রত্যেকেরই বয়স তিরিশের কোঠায়। এদের মধ্যে প্রচন্ড ভাব। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যস্ত কিন্তু প্রতি মাসে চতুর্থ শনিবার যে যেখানেই থাকুক না কেন,  দেখা করে তারা। পুরো দিনটা একসাথে কাটায়, গল্প করে, আড্ডা দেয়, মুভি দেখে, বেড়াতে যায়।

আজ সেই দিনের ঠিক আগের দিন। অর্থাৎ শুক্রবার। হেনা বসে ছিল পাঁচতারা হোটেলের লবিতে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে। লেখালেখির অভ্যেস আছে তার। কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ করেন একজন প্রোডিউসার তার গল্প পছন্দ হয়েছে বলে। তাই আজ হেনা এখানে। বুক ঢিপ ঢিপের কারণ অন্য। প্রোডিউসারের সাথে জনপ্রিয় একজন তারকারও থাকার কথা গল্পের নায়ক হিসাবে। নায়কটি এখনকার একজন নামকরা তারকা আর হেনার হট ফেভারিট!

হেনাঃ এবারে হেনার পরিচয়টা ঝটপট সেরে ফেলা যাক। বাবা মা দুজনেই শিক্ষকতা করেন। একমাত্র মেয়ে সে। এখনো বিয়ে হয়নি। ছিপছিপে গড়নের মিষ্টি মেয়ে। একটা ছোটোখাটো এড এজেন্সিতে কাজ করে আর অবসর সময়ে লেখালেখি করে। পাত্র খোঁজাখুঁজি চলছে, কিন্তু এখনো হেনার বিশেষ একটা কাউকে মনে ধরেনি।

ঝটপট ঘড়ির দিকে দুবার তাকায় হেনা। কখন যে ফোনটা আসবে! তার অবশ্য খুব একটা তাড়া নেই, আজ অফিসে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু.. চারপাশে তাকিয়ে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ ফিল করছে না! এমন জায়গায় যে আগে কখনোই আসেনি তা নয়, তবে একা বসে থাকাটা বোধহয় আর একটু অন্যরকম।

বেশীক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হল না। ফোন এসে গেল, তাকে রুম নম্বর ৩০২ এ আসতে বললেন অবাঙালি প্রোডিউসর গগন সুরী। একটা খুব জমাটি শর্ট ফিল্ম বানানোর অপেক্ষায় তিনি। গল্প সিলেকশন প্রসেস চলছে। রুমের সামনে পৌঁছে ধুকপুকুনিটা যেন হাজারগুণ বেড়ে গেল ওর। ঢুকতেই যাবে, এর মধ্যে যূথিকার ফোন..

“হ্যাঁ, বল”

“এইত্তো ঘুম ভেঙেছে আদুরে মেয়ের?”

“কি যা তা বলিস না.. আমি এতোক্ষণ ঘুমোই?”

“তা অবিশ্যি ঠিক জানিনা, তবে ছুটি যখন আর এটা যখন আমাদের আদরের মিষ্টি বাচ্চা বাচ্চা বান্ধবী হেনা, তখন ঘুমোতেই পারিস!”

“বাজে বকা বন্ধ করবি? এই শোন আমি একটা জায়গায় এসছি, তোর সাথে একটু পরে কথা বলছি!”

“আচ্ছা বাবা চটিস কেন.. কাল আসবি তো?”

“হ্যাঁ আসবো, এখন রাখ!”

ঝটপট ফোনটা রেখে হেনা কলিং বেলটা বাজালো। একজন লম্বা ছিপছিপে চেহারার লোক এসে দরজা খুললেন। ভদ্রলোককে হেনা এর আগে কখনো সামনে থেকে দেখেনি। একটা বিশাল সোফার একপাশে তিনি, আর একপাশে সেই জনপ্রিয় তারকাটি বসে আছে। হেনা কড়া এসির মধ্যেও ঘামতে শুরু করল।

সামনের টেবিলে অনেক কাগজপত্র অবিন্যস্ত ছড়ানো। তারকাটি মুভি, শর্ট মুভি, সিরিজ সবই করেন। তাকেও তার গল্পের প্রিন্টআউট নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। হেনার গল্পটা রহস্য গল্প.. একজন গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশের বিভিন্ন রহস্য উন্মোচন। প্রধান চরিত্রের নাম রুদ্র গাঙ্গুলি যেই চরিত্রে ইনি অভিনয় করবেন। অবশ্য আদৌ তার গল্পটি যদি মনোনীত হয় তো!

প্রাথমিক আলাপ পরিচয় শেষ হওয়ার পরই হেনা তার প্রিন্টআউটটা বের করতে গিয়ে দুবার করে হাত থেকে ফেলে দিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে যখন কাগজটা সুরী জির দিকে বাড়াতে পারলো, আড়চোখে দেখল কৌতুক আর কতোকটা করুণা মিশ্রিত দুটো চোখ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। গল্প পছন্দ হয়ে গেল প্রোডিউসরের। পরের মাস থেকেই কাজ শুরু করতে চান তিনি। ভালোমতোই রয়্যালটি অফার করলেন তিনি হেনাকে। অবশ্য পছন্দ না হওয়ার কিছু ছিল না, হেনা সত্যিই খুব ভালো লিখতো।

ভিতরে থাকাকালীন হেনার চোখ বারবারই চলে যাচ্ছিল তার পছন্দের মানুষটির দিকে, কিন্তু তাকে খুব একটা কথা বলতে দেখা গেল না। পরের দিকে তার একটা ফোন এসে যাওয়াতে উঠে অন্য পাশে চলে গেলেন।

বাইরে এসে জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল হেনা। এতোক্ষণ যেন দমটা আটকে ছিল। উফফ দারুণ খবর। কালকে গ্রুপ মিটে বললেই নির্ঘাত মিটের পুরো খানাপিনাটাই তাকে স্পনসর করতে হবে। তা হোক.. এতো ভাল খবর,, আর সেই কোন ছোট্টবেলার বন্ধু তারা! একটা এগরোলে কামড় বসিয়েই যূথি অর্থাৎ যূথিকাকে একটা ফোন লাগালো হেনা।

যূথিকাঃ ঘর্মাক্ত কলেবরে বাড়ি ফিরেছে যূথিকা, একটা বাজে তখন। আসামাত্রই শোভনাদেবীর চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। বাড়ির বউ ড্যাং ড্যাং করে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তাকে সব কাজ করে মরতে হচ্ছে! এখনই বা ফেরা কেন বাপু, একবারে রাতে ফিরলেই তো হত, স্কুলে যায় না আর কোথায় যায়, এইজন্যই আজ অবধি কোনো সন্তান হয় নি.. ইত্যাদি ইত্যাদি। যূথিকার আজকাল গা সওয়া হয়ে গেছে। খুব একটা উচ্চবাচ্য না করে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল সে। চিৎকার চলতেই লাগলো। বছর পাঁচেক হল বিয়ে হয়েছে, কতোবার ভেবেছে বেরিয়ে যাবে,, কিন্তু হয়ে আর ওঠেনি।

যূথিকাঃ বোলপুরের মেয়ে.. বাবা অনেক ছোটবেলা থেকেই নেই। মা আর দুই বোন। অনেক কষ্ট করে হলেও মুক্তভাবেই বড়ো করেছেন তাদের। পলাশের সাথে তার নিজের পছন্দ করাই বিয়ে, কিন্তু মানুষটাকে চিনতে বোধহয় খুব ভুলই হয়েছিল তার। অত্যন্ত স্বার্থপর ছোট মানসিকতার মানুষ। মায়ের মতোই বিভিন্ন খারাপ কথায় সারাক্ষণ বিদ্ধ করতে থাকে তাকে। নিজের এমন কিছু ভাল রোজগার নয়, কিন্তু স্ত্রীর কাজ করাও তার একেবারেই পছন্দ নয়। অতো সকালে উঠে সমস্ত কিছু করে রেখে বেরিয়েও কখনোই তাদের সুনজরে আসতে পারেনা যূথি। জীবনটা যেন নরক হয়ে উঠেছে তার। বন্ধুরাই তার জীবনের একমাত্র অক্সিজেন। মাসের ওই একটি দিনের দিকে তাকিয়েই হাঁ করে বসে থাকে।। (ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *