পথের শেষ কোথায়!!!
গোপা ভট্টাচার্য্য
ক্লান্তিতে শরীর শিথিল হয়ে আসছে।
প্রায় বারো ঘণ্টা যাবৎ হেঁটেই চলেছে মনোজ। একটু দাঁড়িয়ে পড়ে সে। নাহ্, থামলে চলবে না। যে করেই হোক বাড়ীতে পৌঁছতেই হবে তাকে। এই ভেবে আবার পথ চলা শুরু করে সে। বাড়ীতে যে বুড়ো মা , বাবা তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে! অনেক বাসনা নিয়ে সুদূর বিহার থেকে প্রায় বছরখানেক আগেই মহারাষ্ট্রে আসে সে। এক কারখানায় শ্রমিকের কাজ পেয়েও যায়। বুড়ো বাবা মাকে একটু ভালো রাখার আশায় রাত দিন পরিশ্রম করে কিছু উপার্জন করে। এবার বাড়িটাকেও একটু ঠিক ঠাক করে নিতে হবে। কতো কী স্বপ্ন তার চোখে! ২৪ বছরের যুবকের মনে যা যা স্বপ্ন থাকার কথা ,সবই তো তারও আছে। আজকাল তার মনটাও ভালোবাসার জোয়ারে উথাল পাতাল করে। এখন তার মন জুড়ে আরও একজন এসে ভিড় করেছে। সে তার গ্রামেরই মেয়ে মীনা। তার ডাগর ডাগর চোখে সে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চায়। তার মন প্রাণ জুড়ে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে মেয়েটা। সেও তাকে খুব ভালোবাসে। তার দুচোখেও একসাথে সংসার বাঁধার স্বপ্ন এখন। কথা ছিলো এবার রাজ্যে ফিরলেই বিয়ের দিন পাকা করে ফেলবে মনোজ।
হঠাৎ করে কি থেকে কি যে হয়ে গেলো! সমগ্র বিশ্বে এমন একটা বিপর্যয় নেমে আসবে কে জানত ! দেশের পরিস্থিতিও খারাপের দিকে যাচ্ছে। লক ডাউন ছাড়া কোনো পথ নেই, সরকার জানিয়ে দিয়েছে। যার ফলে কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কষ্ট করে খেটে জমানো টাকা প্রায় শেষ হতে চলল। পরিস্থিতি দিন দিন আরও সংকটময়। তাই লক ডাউন আবার বাড়িয়ে দিল সরকার। বিপাকে পড়ে গেলো মনোজ আর তার মতো অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক। ওদিকে মা বাবাও তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। এমত অবস্থায় কি করবে বুঝতে পারে না মনোজ। অনেক ভেবেও কিছু উপায়ান্তর না দেখে পায়ে হেঁটেই বাড়ীর অভিমুখে রওনা হলো সে। রাস্তায় পুলিশের চোখে পড়লে বাধা দেবে , সেই ভেবেই তাঁদের চোখ এড়িয়ে রেল লাইনের উপর দিয়ে চলতে শুরু করল সে। মনে মনে ভাবছে , আর কত দূর , এই পথ যেন শেষ হচ্ছে না আর। মায়ের মুখটা মনে পড়ল তার। মা কিছুতেই চায় নি সে এতো দূরে চলে আসুক। আজ মনে হচ্ছে, মায়ের কথাটা শুনলেই পারতো।
রাতভর পায়ে হেঁটে পথ চলায় তার শরীর ক্রমশ ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে পড়ছে । পায়ে যেন আর পর্যাপ্ত জোর পাচ্ছে না। তেষ্টায় গলাটাও কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
রেল লাইনের উপর বসে পড়ল। ইস্, কোমর যেন টনটন করে উঠলো।
জলের বোতল থেকে কিছুটা জল ঢক ঢক করে পান করে নিল। প্রচণ্ড ক্ষিদে অনুভব হলো তার। কালকের তিন চারটা রুটি কাপড়ের পুঁটুলিতে বেঁধে সাথে করে নিয়ে এসেছিল মনোজ। তার থেকে দুটো বাসি রুটি বার করে খেয়ে নিল। তারপর মনে মনে ভাবল, একটু জিরিয়ে নেওয়া যায় এখানে । আরও অনেকটা পথই তো যেতে হবে, তাছাড়া পা দুটোও টন টন করছে। নিজের গলার গামছাটা রেল লাইনে পেতে তার উপর গা টা এলিয়ে দিল সে। মাথার উপর খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো। আজ আকাশটা অপূর্ব সুন্দর লাগছে। এমন আকাশ তো এর আগে সে কখনও দেখে নি! পূর্ব দিগন্তে রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে সম্পূর্ণ পূর্বাকাশ। রক্তিম বলয়ের আকারে রবি, পূব আকাশের বুকে উঁকি মারছে। উদয় দিগন্তের দিকে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল মনোজ। কী অপরূপ সে দৃশ্য ! তক্ষুনি একদল পরিযায়ী পাখিকে উড়ে যেতে দেখতে পেলো। তার মনে হলো, হয়ত তারই মতো ওই বিহঙ্গীরাও নিজের দেশে আপন সঙ্গীদের কাছে ফিরছে।
আহা কি সুন্দর এই পৃথিবী !! চারপাশটা সবুজে সবুজ, নানান গাছ গাছালিতে আচ্ছাদিত । এর আগে নিজের পৃথিবীকে এমন করে কখনো দেখার সুযোগ হয় নি মনোজের। এক মৃদু বাতাস তার শ্রান্ত তনুকে ছুঁয়ে গেলো। আহ্, কী আরাম ! শরীরটা জুড়িয়ে গেলো তার।
হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ ঠিক কানের পাশটা দিয়ে যেন চলে গেলো। চমকে জেগে উঠে বসলো মনোজ। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। নাহ্ বেলা হয়ে গেলো, এবার এগোতে হবে। একটু বিশ্রাম শরীরটা বেশ সতেজ হলো মনে হলো তার। পায়ের ব্যথাটাও আর নেই। নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। এবার আবার জোরে পা চালাতে হবে। এই ভেবে এগিয়ে গেলো সে। এবার খুব দ্রুত গতিতে ছুটছে মনোজ। বেশ ভালো লাগছে মনোজের। ছোটবেলায় এই রেল লাইনের উপর দিয়ে কতো দৌড়েছে। দৌড়ে পাড়ার সঙ্গীরা কেউ তাকে কখনো হারাতে পারেনি। শৈশবের সেই পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো। সত্যিই তো আজও সে আগের মতোই দৌড়তে পারে। এবার মায়ের কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে। মায়ের হাতের কচুরির কথা মনে পড়ে গেলো। আহা কতদিন মায়ের হাতের রান্না খায়নি । মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ এতদিনে কোথাও খুজেঁ পায় নি । এবার থেকে মায়ের সব কথা মন দিয়ে শুনবে। আর নিজের রাজ্য ছাড়বে না সে। মীনাকে বউ করে ঘরে তুলে আনবে। একসাথে সবাই মিলে আনন্দে থাকবে।
এই তো বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। মনোজের চোখ মুখে ক্লান্তি মুছে গেছে সেই কখনোই । বাড়ী পৌঁছনোর আনন্দে চোখ মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে তার। বাঁশের গেট পেরিয়ে উঠোনে এসেই মা.. বলে ডাকল সে। মা কোনো আওয়াজ দিলেন না তো ! বেরিয়েও এলেন না ! জোরে পা চালিয়ে ঘর অবধি পৌঁছতেই বাড়ীর সমুখে কিছু লোকের জটলা দেখতে পেল মনোজ। কি হলো বুঝতে পারলো না তক্ষুনি। মা বাবা দুজনে ঠিক আছেন তো? মনে কু ডাকল। হঠাৎ মীনাকে ছুটতে ছুটতে বাড়ীর গেট পেরিয়ে আসতে দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। মনোজের পাশ কাটিয়ে মীনা কাঁদতে কাঁদতে প্রতিবেশীদের জটলা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। তাকে লক্ষ্য করলো না দেখে অবাক হলো মনোজ। ভিড় ঠেলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো সে। সেখানে গিয়ে যা দেখলো তাতে সে একেবারে চমকে গেলো। মনোজের ছবি বুকে নিয়ে মা মূর্ছিত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন। এদিকে বাবা বিলাপ করতে করতে বলছেন ,
বাছা রে, কেনো আমাদের ছেড়ে চলে গেলি? এই বুড়ো বাপটার কি হবে এবার ?
কাঁদতে কাঁদতে অনবরত নিজের কপাল চাপড়াচ্ছেন।
এই কি কান্ড হচ্ছে এখানে ! অবাক হয়ে মনোজ সজোরে কথাটা বলল। কেউ ওর দিকে তাকিয়ে দেখল না। যেন কেউ ওর কথাটা শুনতেই পায় নি। এগিয়ে মায়ের শিয়রের কাছে গিয়ে বসলো মনোজ। মা , ওমা!!
সংজ্ঞা হারিয়ে মা ছেলের ছবিটা ধরে পড়ে আছে।
ওদিকে মায়ের পাশে বসে মীনা কান্নায় ভেঙে পড়েছে।
মীনা কে ডেকে মনোজ বলল,
__ আরে , তোমাদের হয়েছে টা কি? এই তো আমি এসে গেছি। দেখতে পাচ্ছ না ?
মনোজের সব কথা হাওয়ায় যেন মিশে যাচ্ছে।
মীনা শুনতে পেলো না তার কথা। এমনকি তার দিকে চেয়ে পর্য্যন্ত দেখল না।
এ কী হচ্ছে তার সাথে ?!
চিৎকার করে মনোজ বলল,
আমি তো বেঁচে আছি !!!!
এই তো আমি … কেউ কেনো আমাকে দেখতে পাচ্ছ না !!!!!
তার সব কথা কারো কানের দুয়ারেও পৌঁছলো না , সব কেমন মেঘ হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেলো।