Spread the love

উড়ান (পর্ব- ১৩)

দেবস্মিতা রায় দাস

এম্বুল্যান্সে সারা রাস্তা পালকের হাতটা ধরে বসে রইল মীরা। অপলক দৃষ্টিতে তার নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। রোহিত রায়, জিৎও গেলেন সাথে। বাকি প্রতিযোগীদের কাউকে নিয়ে যাওয়া হল না। 

পুলিশে এবার সত্যিই খবর দিতে হল। তুষারকে দুবাই পুলিশ এসে ‘এটেম্পট টু মার্ডার কেস’ এ তুলে নিয়ে চলে গেল। পরে তাকে ইন্ডিয়ান পুলিশের হাতে ট্রান্সফার করা হবে।

ঝিলমকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল,, ফিরে গিয়ে ওর টার্মিনেশন লেটার নিজের হাতে টাইপ করবেন বললেন রোহিত রায়। আটজন তো এসেছিলই, তাই ওদের দুজনের বদলে আর দুজনকে নিয়ে নেওয়া হল। বাকি সকলকে বিশ্রাম নিতে পাঠিয়ে দিলেও মীরাকে কিছুতেই পাঠানো গেল না। সেও একজন প্রতিযোগী। তার উপর দিয়েও অনেক ধকল গেছে। কিন্তু পালককে ছেড়ে সে একবিন্দু নড়তেও রাজি নয়।

পালকের অবস্থা দেখে রোহিত রায়ের ভিতরটা যেন কুঁকড়ে গেছে একেবারে, কিন্তু এতোগুলো লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে নারাজ৷ তাই দায়িত্ব স্যামের হাতে অর্পণ করে এসেছেন। রীনা ম্যাডামও তাদের সাথে এসেছেন। করণও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু রোহিত রায় কড়াভাবে না করে দিয়েছেন। তিনি পালকের আর কোনো ক্ষতি চান না। আর কিচ্ছুক্ষণ পরে তাকে খুঁজে পেলে আর হয়তো বাঁচানোই যেত না৷

বাপ মা মরা হাসপাতালে শুয়ে থাকা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না, কেঁদে ফেললেন। দু এক ঘন্টা না পেরোলে কিছু বলা যাবে না, বলে দিয়েছে ডাক্তার। পুরো ঘটনাটা শুনেছেন তিনি ঝিলমের মুখ থেকে৷ মেয়েটা কি সত্যিই তবে তাকে এতোটা ভালোবাসে? তবে তো এই ঘটনার জন্য তিনিও অনেকখানি দায়ী। তিনি কি আদৌ ওর যোগ্য? এতো ঘটনাপ্রবাহ তার জীবনে.. বড্ড জটিল.. এর মধ্যে ওই সরল মেয়েটাকে জড়িয়ে ফেলাটা কি ঠিক হবে?? তিনিও মনে মনে ওকে ভালোবেসেছেন ঠিকই! তবে.. নাঃ মেয়েটাকে বোঝাতে হবে!! তার থেকে জিৎ অনেক ভালো জীবনসঙ্গী হতে পারবে ওর! খুব ভালো ছেলে। সৎ, নির্লোভ, কেয়ারিং, খুব ভালো মনের মানুষ। আর খুব ভালোবাসে পালককে। মুখে বন্ধু বললে কি হবে, তিনি কি আর বোঝেন না! পালক সুস্থ হলেই ওর সাথে কথা বলবেন এ ব্যাপারে। অদ্ভুতভাবে দেখলেন এখন আর প্রতিযোগিতার কথা তার মাথাতেও আসছে না, খালি মনে হচ্ছে পালক সুস্থ হয়ে প্রাণবন্ত ভাবে আবার ফিরে আসুক তাদের কাছে।

তার চিন্তায় ছেদ ফেলে জিৎ এসে বসল তার পাশে। এখনও হুঁশ ফেরেনি পালকের। জিৎএর বড্ড শ্রান্ত লাগছে। জীবনের সর্ব অবস্থায় যে কোনো ব্যাপারে সবসময় সাহস দিয়ে এসেছে পালককে, অথচ আজ যখন তার জীবনবাতি নিভু নিভু প্রায়,, তখন আর সে নিজেই কোনো সাহস খুঁজে পাচ্ছেনা মনের মধ্যে। মায়ের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছে৷ তাকে মনের জোর রেখে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে বলেছেন। রোহিত রায় একটা হাত রাখলের জিৎএর কাঁধে। জিৎএর গলার কাছে একটা দলাপাকানো কান্না জমাট বেঁধে ছিল,, সেটা এবার বেরোনোর উপক্রম হল। কোনোদিন কারো ক্ষতি করেনা মেয়েটা.. মনের মধ্যে কোনো জটিলতা নেই.. জীবনে কিছু করে দেখাতে চায়, তার সাথেই কেন বারবার এমনটা হয়??

মীরা আর রীনা ম্যাডাম পালককে যেখানে রাখা হয়েছিল, ঠিক তার বাইরেটায় বসে ছিলেন। ভিতরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছেনা। একসাথে স্যালাইন অক্সিজেন চলছে পালকের। তাকে ওই অবস্থায় দেখে মীরার শক্ত মন যেন আরো দৃঢ হয়ে উঠল। মনে মনে স্থির করল পালক সুস্থ হয়ে যদি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে, তবেই সে নিজে অংশগ্রহণ করবে.. নাহলে সে নিজেও অংশগ্রহণ করবে না। তাতে যে যা বলে বলুক। মনের জোর তার প্রচুর ছিল, সহজে ভেঙে পড়ার পাত্রী সে ছিল না। পালকের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলল..

“জীবনে অনেকটা লড়াই করে এই জায়গায় পৌঁছেছি। তোমাকেও অনেক লড়াই করতে দেখেছি পালক, নিজের সাথে, আশেপাশের লোকজনের সাথে, পারিপার্শ্বিক অবস্থাবিশেষের সাথে.. এই লড়াইয়ের মর্ম আমি বুঝি, তাই সেটা কোনোভাবেই নষ্ট হতে আমি দেব না! লড়াই তোমায় করতেই হবে, আরো একটু তার এখনো বাকি! একবার শুধু চোখ মেলে উঠে বসো.. প্রতিযোগিতায় নিয়ে গিয়ে তোমায় বসানো আমার দায়িত্ব। তাতে আমি নিজে যেতে না পারি, সেও ভালো। লড়াই তোমায় করতেই হবে পালক, ছুটি তুমি পাবে না!!”
চোখ দিয়ে অবিরল অশ্রু ঝরছে তার।

মীরার কথাই যেন ঈশ্বর শুনতে পেলেন। তাদের সকলের প্রার্থনাকে সত্যি করে পালকের জ্ঞান ফিরল ভোর পাঁচটা নাগাদ। খুব দুর্বল.. গায়ে কোনো শক্তি নেই.. অনেক কষ্টে চোখ মেললো। সকলে যেন আশা করেছিল যে চোখ মেলেই পালক মীরা বা রোহিত রায়কে খুঁজবে। তা কিন্তু হল না। অদ্ভুতভাবে পালক উঠেই জিৎকে আঁকড়ে ধরল। ছোট বাচ্চার মতোন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। জিৎ ও নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।

সেইদিনই রাতে প্রতিযোগিতা। কে জানে মীরার সেই অনুচ্চারিত মনের কথা পালক শুনতে পেয়েছিল কি না, এই অবস্থাতেও সকলকে অবাক করে দিয়ে স্টেজে উঠবার সিদ্ধান্তই সে নিল। রীনা ম্যাডাম চিন্তান্বিত কন্ঠে বললেন..

“এই অবস্থায় আর কোনো চাপ নেওয়া কি তোমার শরীরের পক্ষে ঠিক হবে পালক? জীবন তোমায় আরো সুযোগ নিশ্চই দেবে! তুমি কি বলো রোহিত?”

বলে রোহিত রায়ের দিকে তাকালেন। রোহিত রায় ঘাড় নাড়লেন..

“তুমি আমাদের কাছে সুস্থ হয়ে ফিরে এসছো, এটাই আমাদের কাছে অনেক! আমরা আর কিচ্ছু চাই না! হ্যাঁ, আর একটা কথা, মীরাকে কি পরিমাণ ভুল বুঝেছিলে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো। তোমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক, এটাই চাইব। আরো একজন খুব ভালো বন্ধু তুমি পেয়েছো পালক, তাকে কিন্তু কখনো হারাতে দিও না তোমার জীবন থেকে!”

পালক অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো জিৎএর দিকে। এবারে মীরা বলে উঠল..

“সব ঠিক আছে, কিন্তু পালক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেই। এখনো অনেক সময় বাকি। কি করে সেটা আমার দায়িত্ব। তবে এইটুকু বলতে পারি, ও না অংশগ্রহণ করতে পারলে কিন্তু আমিও করব না!”

মীরা আর রাহুল না থাকলে যে প্রতিযোগিতায় নাম দেওয়ারই অর্থ নেই, এটা সকলেই জানতো। তাই এবার সকলেই সায় দিল, আর পালকও সম্মতি জানিয়ে বলল সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে তাদের মান রাখার আর নিজের আর তার মায়ের স্বপ্নপূরণ করার। জিৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। একটা বড়ো বোঝা যেন তার বুক থেকে নেমে গেল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পালককে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল।।

ক্রমশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *