গোপাল দেবনাথ,
পূর্বরঙ্গ মানেই এক অন্য ভাবনা। সমাজ জীবনের এক জলন্ত ছবি। চাষিদের আন্দোলন যখন গোটা দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে তখন “জমি যার নাঙল তার” এই চিরাচরিত দাবি বড় বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
যদিও এ নাটকের দাবি চিরকালীন। মানুষের প্রথম অধিকার খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান। বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু এই নূন্যতম চাওয়া পাওয়ার জন্যে প্রাচীন সময় থেকেই লড়াই চলছে। আজকের সময়েও এখনও এই শর্ত পূরণের আশায় বহু মানুষের দিন গোনা চলছে। কিন্তু একদিন এ লড়াই এর শেষ হবেই। ঐক্যবদ্ধ মানুষ বুঝবেই, প্রকৃতির সম্পদে তাদের দাবি। অবসান হবে সমাজের সংখ্যালঘু ধনীর শোষণ। প্রতিষ্ঠিত হবে সেই চিরন্তন সত্য, লাঙ্গল যার জমির ফসল তার। আবারও সৃষ্টি হবে আদিম শোষণমুক্ত সমভোগী সমাজ! নাটকে এই মূল ভাবনার সূত্রপাত একটি মানুষকে নিয়ে। তবে ও মানুষ না দৈত্যদানো তা নিয়ে আশপাশের গাঁয়ের মানুষের মধ্যে সংশয়। কেননা এই ধু ধু ফাঁকা শস্যক্ষেতে লোকটা একা থাকে, একা ধানক্ষেত, গাছ, পাখপাখালি, মাঠ, নদী আকাশের সঙ্গে কথা বলে। তাই এই বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত জুড়ে এক গা ছমছমানি ভয় জানা বাঁধে। আর লোকটিকে ঘিরে নানান কথা নানান গল্প তৈরি হয়। হঠাৎই কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে ঐ বিস্তীর্ণ জমিতে এসে হাজির হয়। লোকটা মেয়েটাকে দূর করে দিতে চায়। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মে তারা একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে এক ভালোবাসার জন্ম হয়। লোকটা অনুভব করে যে জমি এতোদিন ধরে সে লালন করে এসেছে, তাতে তারও অধিকার আছে। ফলে জমির তথাকথিত দখলদার যখন শষ্যের দখল নিতে চায়, তখন সে রুখে দাঁড়ায়। ক্রমে আশেপাশের গ্ৰামের পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোও উপলব্ধি করে ফসলের অধিকার। তারাও তাই শেষ পর্যন্ত মানুষটির পাশে এসে দাঁড়ায়।
মণি মুখোপাধ্যায়ের একটি ছোট্ট গল্পকে আশ্রয় করেই নাটকের বুনন। মলয় রায়ের নাটক রচনা ও সামগ্ৰিক ভাবনা কে ভর করে অপূর্ব নাট্যশিল্পকর্ম তৈরি করেছেন রোকেয়া রায়।রোকেয়ার তারিফ না করে পারা যায়না। শুধু অভিনয় বা পরিচালনা নয়, রোকেয়ার মঞ্চ ভাবনাও অসাধারণ! আরও ভালো লাগে, তখন জানা যায়, এই মঞ্চ এবং মঞ্চ উপকরণ রোকেয়ার সঙ্গে হাত লাগিয়ে নির্মাণ করেছেন দলেরই কুশীলবরা। ওয়ার্কশপ ভিত্তিক এ নাটকের আলো, আবহ সঙ্গীত, মঞ্চ সবটুকুর ভাবনা ও প্রয়োগ পূর্বরঙ্গের। ফলে এ নাটকে প্রকৃত গ্ৰুপ থিয়েটারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন পাওয়া যায়।
নাটকের স্ক্রিপ্ট অসাধারণ! তারই সঙ্গে নাটকের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে অসামান্য কয়েকটি গান লিখে মলয় তাকে প্রচলিত লোকগানের সুরে অপূর্ব ভাবে বেঁধে দিয়েছেন। অন্যান্য কিছু পুরনো গানের নতুনভাবে প্রয়োগ মন ছুঁয়ে যায়। সব গানই জয়দীপ সিনহা সহ পূর্বরঙ্গের কুশীলবরা গেয়েছেন। মঞ্চের ওপর কুশীলবরা গান গেয়েছেন, অদ্ভুতভাবে কন্ঠ নিসৃত শব্দে আবহ সৃষ্টি করেছেন। আবহ নিয়ন্ত্রণ করেছেন তীর্থেন্দু দত্ত। আলো চোখের শান্তি। অপূর্ব আলোক ভাবনা এবং অসামান্য আবহ ভাবনাও মলয়ের। আলোক নিয়ন্ত্রণ করেছেন শশাঙ্ক মন্ডল। শুরুতেই ধান রোযার দৃশ্যটা আলো আঁধারে স্বপ্নের মতন মনে হয়।
মায়াবী আলোয় অভূতপূর্ব মঞ্চ এবং অনন্যসাধারণ আবহে এবং রোকেয়া সহ প্রত্যেকের প্রাণবন্ত দুরন্ত অভিনয়ে
মন একেবারেই অভিভূত হয়ে যায়। নাম চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রভাত তরফদার। এছাড তৃষ্ণা, উপদেশ, সুব্রত দেবীপ্রসাদ, অলি, কৌস্তুভ, দেবস্মিতা, জ্যেতির্ময়, শুভ্রদীপদের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হবে।
“লোকটি ” সত্যিই খুবই বলিষ্ঠ প্রজোযনা
এটাই হচ্ছে আসল সত্যিকারের মানুষের জন্য নাটক। নাটকটি দেখে সত্যিই অভিভূত হতে হয়! এই উপস্থাপনাটি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, মাটির অধিকারের কথা বলে। এই অধিকারের জন্য মানুষের আদিম লড়াইয়ের কথা বলে,
মানুষের চিরকালের স্বপ্নের শোষণমুক্ত, আনন্দময়, স্বাধীন সমাজজীবন যাপনের কথা বলে। এবং এই কথাগুলি তারা বলে কাব্যময়তায় মাখা গদ্যে, সমবেত শারীরিক বিভঙ্গে,আর মাটির ভাষায় লেখা গানে!
এইরকম অস্থির সময়ে এতো সুন্দর একটা প্রযোজনা উপহার দেওয়ার জন্য এবং মানুষের নাটক নতুন করে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার জন্য পূর্বরঙ্গ কে অনেক ধন্যবাদ। নাটকের শেষে কার্টেন কলে সব কলাকুশলীদের উবু হয়ে মাটিতে বসে থাকার দৃশ্যটি বড় মন কেড়ে নেয়, এ যেন যুগ যুগ ধরে এমনই বসে আছে সারা পৃথিবীর সব খেটে খাওয়া মানুষের দল।