Spread the love

মানুষের লোভ ও বন্যপ্রাণী সমস্যা,

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী

    চুপিচুপি সন্ধ্যায় আগমন। অনেকটা কাব্যিক ছন্দে দিনের আলো ফোটার আগেই একইভাবে প্রস্হান। মাঝের প্রায় সাতটা দিন  আতঙ্কে কাটল গলসী ও আউসগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। আবার ফিরে এসে ফসলের ক্ষতি করবেনা তো?- উত্তরহীন প্রশ্নে চিন্তিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত চাষীরা। কারণ যাবার আগে পাকা ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে উনারা। একইসঙ্গে বেশ কয়েকদিনের উদ্বিগ্নতা দূর হলো বনদপ্তরের আধিকারিকদের এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চলা শতাধিক হুল্লা পার্টির সদস্যদের।

        এতদিন কৃষিপ্রধান গলসী বা আউসগ্রাম এলাকার মানুষরা জঙ্গল থেকে হাতি বেড়িয়ে আসার খবর খবরের কাগজের পাতায় পড়েছে অথবা মাঝে মাঝে দলছুট একটা দু'টো হাতিকে দেখেছে। এবারও গলসী এলাকার বাসিন্দারা যখন শুনল এলাকায় হাতি এসেছে, ভেবেছিল হয়তো বা আগের মতই দু'একটা হাতি এসেছে। কিন্তু চমক ভাঙার আগেই দেখল অন্তত গোটা পঞ্চাশেক হাতি ক্ষেতের পাকা ধানের চরম ক্ষতি করে চলেছে। বনদপ্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে হাতি তাড়ানোর জন্য সামান্য কিছু হুল্লা পার্টির সদস্যরাও হাজির। ভেবেছিল সহজেই ওদের নিজেদের বাসস্হানে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব হয়নি। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অতিরিক্ত এবং আরও অভিজ্ঞ হুল্লা পার্টির সদস্য এনে গত ১৮ ই নভেম্বর ভোরবেলায় সফল হয় বনদপ্তর। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে এলাকাবাসী।

         পেটের দায়ে মানুষ বা মনুষ্যেতর প্রাণী সারাদিন যেখানেই থাকুক না কেন দিনের শেষে প্রত্যেকেই নিজ নিজ বাসায় বা পরিবেশে ফিরে আসে। বন্য প্রাণীদের নিজস্ব ঘরবাড়ি না থাকলেও পরিবেশ আছে। এখন প্রশ্ন হলো - সেক্ষেত্রে কি এমন হলো যাতে একদল হাতি হঠাৎ নিজেদের চেনা পরিবেশ ছেড়ে শাবক নিয়ে অচেনা পরিবেশে প্রায় সাতটা দিন কাটিয়ে দিল? 

              বন দপ্তরের আধিকারিকদের বক্তব্য - কৃষিপ্রধান গলসী বা আউসগ্রামের মাঠ এখন পাকা ফসলে ভর্তি। বর্ষার জন্য পানীয় জলেরও অভাব নাই। মূলত পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানীয়ের টানেই হাতিগুলো এখান থেকে সরতে চাইছেনা। কি এমন ঘটল যার জন্য নিজেদের দীর্ঘদিনের বাসস্হানে খাদ্য ও পানীয়ের অভাব ঘটল?

             সভ্যতার নামাবলী গায়ে চাপিয়ে মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে তত সে বিবেকহীন লোভী, বর্বর হচ্ছে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে তত সে প্রকৃতির উপর অত্যাচার শুরু করেছে। জঙ্গলের গাছ কেটে সাফ করে দিচ্ছে। সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে হাই রাইজার বিল্ডিং। কোলাহলে ভরে যাচ্ছে জঙ্গলের নীরব পরিবেশ। একে নিজেদের বাসস্হানের সীমা কমে গিয়ে খাদ্য ও পানীয়ের অভাব ঘটছে, অন্যদিকে মানুষের ভিড়ে আপন পরিবেশে নিজের মত করে বাঁচার সুযোগও নষ্ট হচ্ছে। দুয়ের চাপে পড়ে কিছুটা বাধ্য হয়েই হাতির দল বারবার নিজের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ছে। 

        নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনদপ্তরের জনৈক আধিকারিকের বক্তব্য জঙ্গল মাফিয়াদের হাত থেকে গাছ বাঁচাতে না পারলে একদিন বন ফাঁকা হয়ে যাবে। সহজে যাতে চোখে না পড়ে তার জন্য মাফিয়ারা জঙ্গলের ভিতরের গাছ কাটে। ওদের নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে চরম সর্বনাশ হয়ে যাবে। বন ছেড়ে শুধু হাতি নয় অন্যান্য বন্যপ্রাণীরাও বেড়িয়ে আসবে। তৃণভোজী বন্যপ্রাণীরা ফসলের ক্ষতি করবে। অন্যদিকে মাংসাশীরা মানুষকে আক্রমণ করবে। অদূর ভবিষ্যতে মানুষ বনাম বন্যপ্রাণীর লড়াই অনিবার্য। তার আরও বক্তব্য - বন রক্ষার দায়িত্ব শুধু বনরক্ষীদের উপর ছেড়ে দিলে হবেনা। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে যৌথভাবে বনরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। নিয়মিত তৃণভোজী প্রাণীদের খাওয়ার উপযুক্ত গাছ লাগাতে হবে। মাংসাশী প্রাণীদের কথাও ভাবতে হবে।

             এখন দেখার সভ্য মানুষ সভ্যতার ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য কতটা সচেতন হন? না এক্ষেত্রেও লোভী মানুষের দায়িত্ব সাধারণ মানুষকে নিতে হবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *