Spread the love

দুর্গাপুরে বৃহন্নলাদের সম্বর্ধনা,

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,

    কেউ বলে হিজড়া, কেউ বলে বৃহন্নলা অথবা কিন্নর। এখন ভদ্রভাবে বলা হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের। জন্মগত ত্রুটির দায় ওদের না হলেও মানসিক যন্ত্রণাটা ওদের সহ্য করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু মা-বাবা, ভাই-বোন বা আত্মীয়স্বজন নয় সমাজ থেকেও ওরা দূরে সরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ইচ্ছে থাকলেও মা-বাবার বুকে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছেনা। ভাইয়ের কপালে দিতে পারেনা ভাইফোটা। পারেনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর পাঁচজনের মত স্বাভাবিক ভাবে পড়াশোনা করতে। এমনকি চিকিৎসা করতে গিয়েও অবহেলার শিকার হতে হয়। পুজো-পার্বণ সহ কোনো সামাজিক বা পারিবারিক উৎসবে ওরা যোগ দিতে পারেনা। অথচ ওরাও রক্ত মাংসের মানুষ। রক্তদান করতে গিয়েও ওরা রক্ত দিতে পারেনা। কারণ ওদের রক্ত নাকি দূষিত। বহু লড়াইয়ের পর আইনি স্বীকৃতি পেলেও সামাজিক স্বীকৃতি ওরা এখনো পায়নি।  সমাজ ওদের অস্বীকার করলেও সমাজের প্রতি ওদের দায়বদ্ধতাকে ওরা অস্বীকার করেনা। তাইতো করোনা আবহে লক ডাউনের সময় নিজের সাধ্যমতো ওরা অসহায়  মানুষের পাশে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মুখে বা পোশাক পরিচ্ছদে আধুনিক হলেও সামগ্রিক ভাবে মানসিকতায় আমরা আধুনিক হতে পারিনি। তাইতো ওদের প্রতি অমানবিক আচরণ করি। তবুও তার মাঝে কোনো কোনো সংস্হা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওদের পাশে দাঁড়ায়। এই রকমই একটি সংস্হা হলো পশ্চিম বর্ধমানের বিশিষ্ট ডাক্তার উদয়ন চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত 'উত্তিষ্ঠত জাগ্রত' ও 'জাগো নারী' স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংস্হার মূল লক্ষ্য সমাজে প্রতি মূহুর্তে অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও অপমানিত বৃহন্নলা সমাজ কে নিয়ে এক নতুন ভাবনা প্রতিষ্ঠা করা। 
          বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজো আগত। করোনা আবহে বা বন্যা পরিস্থিতিতেও বাঙালি সমাজের মধ্যে সাজো সাজো ভাব। তবুও কোথাও যেন দুর্গাপুরের প্রগতি পল্লীর বাসিন্দাদের একাংশের মনে থেকে গিয়েছিল একরাশ বিষণ্নতা। কারণ ওরা বৃহন্নলা, তথাকথিত আধুনিক  সমাজে ওরা অপাংক্তেয়। ওদের বিষণ্নতা দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংস্হার পক্ষ থেকে এক আড়ম্বর পূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মহালয়ার দিন অর্থাৎ গত ৬ ই অক্টোবর  ওদের সম্বর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
       প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে সোনিয়া, স্বাতী প্রমুখ প্রায় দশ জন বৃহন্নলা সম্বর্ধনা সভায় এসে হাজির হয়। সংস্হার পক্ষ থেকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুষ্প স্তবক, ব্যাচ ও সংস্হার নিজস্ব ম্যাগাজিন। জীবনে প্রথম বারের জন্য সম্বর্ধনা পেয়ে ওরা খুব খুশি। ওদের প্রতিটি আচরণে ধরা পড়ছিল খুশির রেশ। 
        অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্হার প্রাণপুরুষ ডাঃ উদয়ন চৌধুরী, উনার যোগ্য সহধর্মীনি কবিতা চৌধুরী এবং বাবা-মা সুকুমার চৌধুরী ও ইলা চৌধুরী, ভারতী দত্ত, সৌরভ কর সহ সংস্হার প্রায় প্রতিটি সদস্য। 
       জানা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই বৃহন্নলাদের নিয়ে গড়ে উঠতে চলেছে 'অর্ধনারীশ্বর সমন্বয় কমিটি'। আগামী দিনে সংস্হার প্রতিটি অনুষ্ঠানে কমিটির সদস্যরা শুধু  আমন্ত্রিত থাকবেন না, পৃথক ভাবে নয় সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা অনুষ্ঠান পরিচালনাও করবেন। আগামী দিনে ওরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবে। এমনকি সংস্হার পক্ষ থেকে কমিটির প্রতিটি সদস্যের সম্পূর্ণ বিনা খরচে চিকিৎসাও করা হবে। মূল উদ্দেশ্য বৃহন্নলারাও যে মানুষ, সমাজের অবিচ্ছিন্ন অংশ, সবার মত ওদেরও স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপনের অধিকার আছে সেটা সবার সামনে তুলে ধরা। 
     সম্বর্ধনা পেয়ে আপ্লুত স্বাতী দেবী প্রত্যেকের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং কান্না ভেজা কণ্ঠে বলেন - প্লিজ আমাদের দূরে ঠেলে দেবেন না। আমরাও মানুষ। পরিবারের কাছে ফিরে যেতে আমাদেরও মন চাই। দয়া করে আমাদের বাঁচতে দিন।
        অন্যদিকে সোনিয়া দেবী বললেন - আমরা তো কোনো অপরাধ করিনি। তবুও কেন আমরা পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ পাবনা? অন্যান্য জন্মগত ত্রুটিযুক্ত মানুষেরা সমাজে স্হান পেলে আমরা কেন পাবনা? প্রতিটি কথা বলার সময় তার কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল অব্যক্ত কান্না ঝরা অভিমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *