অগ্নিমন্থন
প্রবীর রায় : চলচ্চিত্র প্রযোজক,পরিচালক ও অভিনেতা। কলকাতা, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১। দুবছর আগে আমার পরিচালনায় একটা ফিল্ম রিলিজ হতে হতে হলো না ! “যেতে নাহি দিব ” । উত্তম কুমারকে নিয়ে প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের (Docu – Feature ) ছবি । কেউ তখন ভাবেনি ওনাকে নিয়ে কিছু করা প্রয়োজন বলে । উত্তমকুমারের সম্বন্ধে কিছু সবজান্তা মানুষের জন্য আজও আমার ছবি রিলিজ হলো না ! কিন্তু একটা ভালো হলো উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবি করার হিড়িক পরে গেলো। অর্থাৎ ব্যবসা করার হিড়িক পরে গেলো ! “অচেনা উত্তম”, “অতি উত্তম”, “না জানা উত্তম”…ইত্যাদি , ইত্যাদি , ইত্যাদি….. ! যাঁরা এই সব ছবি করছেন , তাঁরা কিন্তু উত্তমকুমারের কাছে অচেনা, অজানা ! তাতে কিছু যায় আসেনা, ব্যবসা তো হবে ! আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইলো এনাদের জন্য আর যাঁদের শিক্ষায় এনারা উত্তমকুমার সম্বন্ধে শিক্ষিত হচ্ছেন , তাঁদের জন্যও ! আপনারা অনেক অনেক টাকা উপার্জন করুন , খুব ভালো ব্যবসা করুন, এই কামনা করি !
এবার আমি একটা ছবি করছি “অগ্নিমন্থন….. Autobiography of a Film Activist!”
এক আদর্শবান বিখ্যাত চলচিত্র পরিচালক দিব্যজ্যোতির, বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা, শাসক শ্রেণীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত
নদীর ধারে গাছের নীচে বসে থাকা প্রৌঢ় মানুষটি নিস্পন্দ-প্রাণহীন। দৃশ্যমান অস্তমিত সূর্যের রক্তিম আভা নদীর জলে। প্রৌড় মানুষটিকে ঘিরে কৌতূহলী মানুষের ভিড় তার চারপাশে। কৌতূহলী হয়ে দিব্যজ্যোতি বাবু এগিয়ে যান তাকে দেখতে। চমকে ওঠেন ! আশ্চর্য – এতো তিনি ! নিজের ঘরে ইজিচেয়ারে বসা তন্দ্রাচ্ছন্ন দিব্যজ্যোতি চোখ খোলেন। কেন এমন স্বপ্ন তিনি দেখছেন আজকাল ? গ্রামোফোনে বাজছে শচীন কর্ত্তার গান –“ দুর কোনো পরবাসে –“।
ল্যান্ডফোনটা বেজে চলেছে একটানা। ভেসে আসছে রক মিউজিকের তীব্র আওয়াজ। রিয়েলিটি শো য়ের dance rehearsal –এ ব্যস্ত দিব্যজ্যোতির teen age নাতনী দিয়া। দাদান তাকে ডাকেন ‘দোয়েলপাখি’ বলে।
ছেলে অমরজ্যোতি news media জগতের সফল ব্যবসায়ী। তার স্ত্রী ইন্দিরা শহরের নামী সাইক্রিয়াটিস্ট। একে অপরের জগৎ নিয়ে সদা ব্যস্ত। দিব্যজ্যোতির স্ত্রী মালিনী দেবী একটা NGO চালান। মেয়েদের স্ব-নির্ভরতার লক্ষে। রাজনৈতিক বৃত্তের পরিচিত মহিলা। যে কোন রাজনৈতিক পালাবদলে আপোষ করে প্রচারের আলোয় থাকাটাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। তার দোসর তাদের কলেজ লাইফের common friend দীপঙ্কর। বর্তমানে যে একটি বেসরকারী TV চ্যানেলের মালিক। দিব্যজ্যোতির মেয়ে দ্যুতিপ্রভা শান্তিনিকেতনের কৃতী ছাত্রী, বর্তমানে রবীন্দ্রভারতীর অধ্যাপিকা। তার স্বামী অভিমন্যু সাহসী প্রতিবাদী সাংবাদিক- সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত – একজন আধুনিক কবিও বটে।
অন্তর্মূখী, মিতভাষী. প্রচার-বিমুখ গূণী শিল্পীদের তালিকায় দিব্যজ্যোতি। সময়ের অবক্ষয়ের সাথে তাল মেলাতে না পেরে যিনি নিজ গৃহে পরবাসী। .’৬৭- র যুক্তফ্রন্ট, ’৭০ –এর নকশাল আন্দোলন, ’৭৫- এর জরুরী অবস্থা…৩৪ বছরের বাম জমানা পেরিয়ে –‘বদলা নয় বদল চাই’-এর পরিবর্তনের ফাঁসে আজ তার শিল্পীমন দিশাহারা। আত্ম-সঙ্কটে ভুগছেন। সত্তরের দশকে ছোট ভাই আদিত্য র নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার স্মৃতি তাকে প্রতিমূহুর্তে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করে। পরিবারে আজ তিনি বাতিলের তালিকায়। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাস করার মত এই সংসার তিনি তো চাননি ।
অভিজাত বনেদী ব্যবসায়ী বংশের ছেলে দিব্যজ্যোতি।তার দাদু এর প্রতিষ্ঠাতা। দিব্য র বাবার সাথে বিধান রায়, অতুল্য ঘোষ প্রমুখের যোগাযোগ ছিল। অনেক গুণী মানুষের আনাগোনা ছিল তাদের পৈত্রিক বাড়ীতে। সেই বাড়ী আজও রয়েছে নিঃসন্তান দম্পতি অনাথবন্ধু ও তার স্ত্রী বীথির তত্বাবধানে। দেওঘর থেকে হাওয়াবদল করে ফেরার পথে রেল স্টেশনে হারিয়ে যাওয়া ৬ বছরের অনাথ শিশুটিকে নিয়ে এসে মানুষ করেছিলেন দিব্য-র বাবা-মা। দিব্যরা কলকাতার বাড়ীতে চলে এলে অনাথবন্ধু থেকে যায় আমোদপুরে- দিব্য-র পৈত্রিক বাড়ীতে। আর যেখানে সম্পদ সেখানেই লোভ, রাজনৈতিক বাতাবরণে আমোদপুর ও তার ব্যতিক্রম নয়। পড়ে থাকা সম্পত্তি গ্রাস করতে চায় অসাধু চক্র।
আমোদপুরে অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্যে সমৃদ্ধ দিব্য-র ছেলেবেলার স্মৃতি। দিব্য- র মা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পঞ্চকন্যা’-র এক কন্যার
১ সন্তান। ছোট ভাই আদিত্য ছিল প্রেসিডেন্সির মেধাবী ছাত্র ও ভাল ফুটবলার। জন্মদিনে বাবার উপহার দেওয়া ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে Film এর প্রতি আগ্রহ। পরবর্তী কালে Film নিয়ে পড়াশুনা, এবং ছবি নির্মাতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ। কাজের সুবাদে বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সান্নিধ্যে আসা। সেই মেধার যুগে দেখা গুণীজনদের তুলনায় আজকের যুগের মধ্য বা নিম্ন মেধার দাপাদাপি তিনি আজকাল আর সহ্য করতে পারেন না। পরিনামে সম্পর্কে তিক্ততা …বিতর্কে জড়িয়ে পরেন ঘরে-বাইরে।
১৯৭৫ সালের ২৬ শে জুন, যেদিন রাতে জরুরী অবস্থা ঘোষনা হয় সেদিন ছিল দিব্য র বিবাহ অনুষ্ঠান। তিমির, পরিতোষ, দিব্য, দীপঙ্কর এই চার বন্ধুর মধ্যে দিব্যকেই জীবনসাথী হিসাবে বেছে নিয়েছিল মালিনী। আজ বিবাহের ৪০ বছর কাটিয়ে আসার পর মালিনী ভাবে সেদিন হয়তো সে ভুলই করেছিল। আসলে আজকাল দিব্য এইসব মানুষজন দের সাথে ঠিকমতো কমিউনিকেট করতে পারেনা।
দীপঙ্করকে সাথী করে বিভিন্ন TV chanel এ মালিনীর আত্মপ্রকাশ এই ক্ষমতাসীন দের হয়ে চাটুকারিতা, নির্লজ্জ বেহায়াপনা বলে মনে হয় দিব্যজ্যোতির। তা থেকে মতান্তর ঝগড়া। তার মন্তব্য প্রায়ই অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দেয়। ছেলে অমরজ্যোতি ও বাবার কার্যকলাপে বিরক্ত। শুধু তারমত অতি সংবেদনশীল মানুষকে নীরবে বোঝার চেষ্টা করে চলে পুত্রবধু ইন্দিরা। বাড়ীর ও চারপাশের দমবন্ধ করা পরিবেশে দিব্য র একমাত্র খোলা জানালা নাতনী দোয়েল পাখি।তার কাছে অকপটে বলে চলেন তাঁর শৈশব কৈশোর যৌবন ও প্রৌড়ত্বের সীমায় পৌঁছোনোর যাত্রাপথের চড়াই-উৎড়াই।
দিব্যজ্যোতিকে নিয়ে ছবি মাঝপথে আটকে যায়। তরুণ পরিচালক রাজ-এর ওপর অন্যরকম চাপ বাড়তে থাকে। কিন্ত আজও কিছু সৃষ্টিশীল শিল্পনির্মাতা অবশিষ্ট আছেন যারা আদর্শ কে প্রাধান্য দেয়, দল-মতের তাঁবেদারি বা রক্তচক্ষুকে নয়। সন্ত্রাস ও শিল্পের কণ্ঠরোধ কে উপেক্ষা করে উল্টোপথে হাঁটতে চায়। বিরোধ বাড়তে থাকে।
শহরের অন্যতম প্রেক্ষাগৃহে আজ মুক্তি পাচ্ছে “অগ্নিমন্থন”। ছবি শুরু হয় একটি প্রচন্ড বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারিদিক। তার মাঝে জ্বলছে ছবির নাম।
দিব্যজ্যোতির ঠোঁট কাঁপছে। কিছু বলতে চাইছেন তিনি। তার না বলা কথা ফুটে উঠছে প্রেক্ষাগৃহের পর্দায়। ইতিহাস সাক্ষী যুগে যুগে কালে কালে শিল্পীর কণ্ঠরোধ করতে চাওয়া ফ্যাসিস্ত শক্তির পরাজয় হয়েছে সর্বত্র। বিলীন হয়ে গেছে অত্যাচারী শাসকেরা। দিব্যজ্যোতি পাগলের মত হাসতে থাকেন। সে হাসি পর্দায় রপান্তরিত হয় জনতার সন্মিলিত গর্জনে- ‘পথে এবার নামো সাথী…’ । মোমবাতি মিছিলের শান্ত আলোকশিখা গুলো যেন গণদেবতার শক্তিতে মশাল হয়ে দাউদাউ করে জ্বলছে। যেন বলছে –‘ মানবো না এই বন্ধনে, মানবো না এই শৃংখলে- মুক্ত মানুষের স্বাধীনতা-অধিকার, খর্ব করে যারা ঘৃণ্য কৌশলে…’। ছবি শেষ হয় জনগনের উন্মত্ত করতালিতে।
বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে-বিদ্রোহ আজ’- দাবানলের মত খবর ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।ভীত শাসকশ্রেণী। অসাধ্য সাধন করেছেন দিব্যজ্যোতি, পাগলা গারদে বন্দী থেকেও। তিনি বেঁচে উঠছেন দোয়েলপাখির মধ্যে দিয়ে, যে ধরেছে তরুণ পরিচালক রাজ-এর হাত শক্ত করে। আগামী দিন তাদের। কণ্ঠে অগ্নিমন্থন এর রুদ্ধসংগীত।
চিত্রনাট্য ও সংলাপ : অশোক রায় ।
চিত্রগ্রহণ : শান্তনু ব্যানার্জী
শিল্প নির্দেশনা : গৌতম বসু
সম্পাদনা : ঋতম ভট্টাচার্যী
সংগীত পরিচালনা : বুদ্ধদেব গাঙ্গুলী
রূপসজ্জা : বিদিশা বিশ্বাস
নেপথ্য কণ্ঠ : তনুশ্রী দেব , বিশ্বজিৎ দাসগুপ্ত ও অমিত গাঙ্গুলী ।
ভাবনা ও পরিচালনা : প্রবীর রায়।
প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন : মেঘনাদ ভট্টাচার্য, মৌমিতা গুপ্ত , অনিন্দ্য সরকার, মৈত্রেয়ী মিত্র, সোনালী ঘোষ , ঋক দে, সুবীর ভট্টাচার্যী , অশোক রায়, রূপসা পাল, নবাগতা বৈশালী মজুমদার, অশনি দাস ও হৃদন চৌধুরী।