হযবরল (তৃতীয়_পর্ব)
দেবস্মিতা রায় দাস
একটা অটো মিস হতেই হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল লীনার। দেরি করে ফেলেছে, এখানেই বাজে এগারোটা। বারোটায় তাদের মিট করার কথা। আর শহরের যে প্রান্তে মলটি সেটা এখান থেকে বেশ দূরে।
ছুটির দিনেও কাজ কিছু থেকেই যায়। ম্যাডাম সকালে ফোন করায় তাই একটু বিরক্তই হয় লীনা, বুঝতেই পারে কিছু কাজের ডাক পড়বে। মাসে এই একটা দিন কোনো অন্য কাজ ভালোলাগেনা তাদের কারুরই। এটা শুধু তাদের পাঁচজনেরই দিন।
লীনার কথাঃ বাবা মাকে খুব ছোটবেলাতেই হারিয়ে মামাবাড়িতেই বড়ো হয়েছে লীনা। তাই বাবা মা না থাকার অভাবটাও খুব ভালোভাবেই জানে। খুব শান্ত অথচ কঠোর মনভাবাপন্ন মেয়ে লীনা। উত্তর কোলকাতার একটা নামকরা এন জি ওর সাথে কাজ করে ও। হেড অফিস মুম্বাইতে। নিজের ছোটবেলাটা তেমন সুন্দর কাটেনি বলে ছোটো অনাথ বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে চায় লীনা। তার নিজের জীবনের স্বপ্ন নিজের একটা এন জি ও খোলা। কাজটা পেয়ে যাওয়ার পর থেকেই উত্তর কোলকাতায় তার অফিসের কাছেই একটা ফ্ল্যাট রেন্টে নিয়ে নেয় ও। আর কারুর উপর বোঝা হয়ে থাকতে চায়না। স্কুলের এই চারটে বান্ধবী একদম তার প্রাণ।
অনেক চেষ্টা করা সত্বেও একটু দেরীতেই পৌঁছালো লীনা। সবাই তার জন্য নীচে অপেক্ষা করছিল। সকলে কোল্ড ড্রিংকস খাচ্ছিল, ও আসতে তার জন্য একটা নিল।
রঞ্জনা তার স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই জড়িয়ে ধরল লীনাকে, অপূর্ব দেখতে লাগছে তাকে। হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল লীনা.. উফফফ আবার এক মাস পর দেখা হল তাদের.. ভাবা যায়। এই একটা দিন তারা একদম নিজের মতোন করে বাঁচে, নিজেদের সমস্ত কথা শেয়ার করে, আনন্দ দুঃখ কষ্ট বঞ্চনা সমস্ত ভাগাভাগি করে নেয়। যূথিকা তাদের মধ্যে একমাত্র বিবাহিত, এবং সবথেকে পরিণত মনস্ক। এক মাস পর দেখা হওয়ার প্রাথমিক আনন্দের পর সকলে উপরে গিয়ে বসল।
হেনার সাথে যূথিকার সবথেকে বেশী ভাব, আগেরদিন রাতে তাদের অনেক্ষণ কথা হয়েছে। তার গল্প মনোনীত হওয়ার ব্যাপারটা সে জানে, এখন সেটা ছড়িয়ে দিল সবার মধ্যে৷ ব্যস, আর পায় কে? সকলেই পরিষ্কার জানিয়ে দিল.. আজকের ট্রিট পুরোটা তার। হেনাও খুশি হয়েই সায় দিল তাতে।
লেখালেখি তার প্রাণ, তার স্বপ্নপূরণের পথে, বিশেষত তার প্রিয় তারকাটিকে একদম সামনে থেকে দেখেছে.. এখনও যেন কেমন ঘোর কাটছেনা ওর। ভাবতে ভাবতেই কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরে আবার ঢুকে পড়ল.. চোখের সামনে ভেসে উঠল হোটেলের সেই ৩০২ নম্বর ঘর.. আর তাতে শুধু তারা দুজন, তৃতীয় কেউ নেই। পরম ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে, এমন সময় একটা রাম চিমটি পড়ল হাতে.. যূথিকা..
“উঃ, কি হল কি?”
“এই মেয়েটা না সারাক্ষণ স্বপ্নের জগতে বিচরণ করে!! উফফ কি হবে বলতো তোর?”
রঞ্জনা হো হো করে হেসে উঠল। ঘোর থেকে বেরিয়ে পড়াতে হেনা বেশ বিরক্ত..
“কি আবার হবে.. কচুপোড়া.. তোরা কি খাবি বল! মুভি কিন্তু চারটে থেকে.. হাতে বেশী সময় নেই!”
বৃষ্টি আর হেনা খাবার অর্ডার দিতে উঠল। রঞ্জনা খুব হাসিখুশি, কখন জানি ভুলেই গেছে তার ব্রেকআপের কথা। এমনই হয় তারা পঞ্চরত্ন একসাথে থাকলে। নিজেকে সবসময় মেইনটেইন করে রাখতে খুব ভালোবাসে ও। একটু টাচ আপ করার জন্য ওয়াশরুমে যাবে বলে উঠল। ওর বরাবরের অভ্যেস ব্যাগও সাথে নিয়ে যাওয়া।
ওয়াশরুমে গিয়ে ফোনটা বের করতেই দেখল পাঁচটা মিসড কল রোহনের। বিশেষ একটা পাত্তা দিল না, আজকে তো কোনো সময়ই নেই কথা বলার। থাক, কদিন যাক.. জ্বলুক একটু তারপর ভেবে দেখবে। মনে মনে হাসল রঞ্জনা। ভিতরে কেউ ছিলনা সে সময়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বাইরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভালোমতোন টাচআপ করে রঞ্জনা ফিরে এসে বসার সাথে সাথেই দেখল বাকিরা এবং খাবার সবই এসে গেছে। হেনা আর বৃষ্টি মসালা দোসা, রঞ্জনা আর লীনা চাউমিন আর যূথিকা একটা পাস্তা অর্ডার করেছিল। সবাই একটু আলাদা নেওয়ার চেষ্টা করে, যাতে সব ধরনের খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া যায়। পটাপট কয়েকটা খাবারের সাথে সেল্ফি তুলে নিল তারা। এরপর খেতে শুরু করতে যাবে, হঠাৎ লীনার উত্তেজিত কন্ঠস্বরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় তারা..
“রঞ্জু তোর ব্যাগ থেকে ওটা কি উঁকি মারছে?”
“কই!”
অবাক হয়ে দেখল তার ব্যাগের প্রথম চেনটা খোলা আর তার ভিতর থেকে উঁকি মারছে একটা দলাপাকানো কাগজ। সাথে সাথে খাবার ভুলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সকলে সেই কাগজটার ওপর। বৃষ্টির অনুসন্ধিৎসু মন আর থাকতে পারলোনা….
“কই দেখি কি লেখা”..
যূথিকা বেশ বিরক্ত..
“আঃ, দাঁড়া না.. রহস্য দেখলেই এই মালটা আর থাকতে পারে না, কিরম লাফাচ্ছে দেখ!”
বৃষ্টিও দমার পাত্র নয়..
“উফফ তাহলে তুইই পড় কি আছে, আমার আর তর সইছেনা!”
যূথিকা মেলে ধরল কাগজটা সকলের সামনে টেবিলের উপর। ওবাবা এ যে একটা কথা নয়, বেশ কিছু কথা লেখা, খুব ছোট অবয়বে নীল কালিতে আর বাচ্চাদের মতোন আঁকাবাঁকা ভাবে। হয়তো আসল হাতের লেখাটা যাতে ধরা না যায়, তাই৷ যূথিকাই পড়তে শুরু করল আস্তে আস্তে..
“ব্রেকআপই ভালো, তুমি আরো বেটার ডিসার্ভ করো.. খুব সুন্দরী কিন্তু তুমি ‘র’।
বাকিদের ভালো থাকার মধ্যে তুমি নিজের ভালো থাকা খুঁজে পাও, খুব সুন্দর মনের মেয়ে তুমি ‘ল’।
স্বপ্নপূরণ হল শেষমেশ ৩০২ নম্বর ঘরে? দারুণ লেখিকা কিন্তু তুমি ‘হ’।
আর কতোদিন এ জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করবে, এবার কিছু ভাবো, দারুণ পরিণত আর বুদ্ধিমতী মেয়ে তুমি ‘য’।
কিছু রহস্য পাওয়া গেল নাকি মিডিয়া হাউসে? দারুণ সাহসী মেয়ে বটে তুমি ‘ব’।
বলছি, পঞ্চরত্নকে দিয়ে কি কোনো ভালো কাজ হবে??
ইতি অর্বাচীন ‘অ’ “
যূথিকার পড়া শেষ হলে আগে কিছুক্ষণ হাঁ করে সকলে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
“ইশশ শেষে আবার ন্যাকামি করে অর্বাচীন লিখেছে দেখো.. লুকিয়ে নজর রাখে আবার ফাজলামি হচ্ছে.. সামনে পেলে না সব ন্যাকামি ঘুচিয়ে দেব”….
রাগী স্বরে হাতে মুঠো পাকিয়ে ফোঁস করে ওঠে বৃষ্টি।
“হ্যাঁ, কে জানতে পারলে না দেখাতাম”.. সায় দেয় হেনা।
” তুই চুপ কর ভীতুর ডিম একটা। তুই আবার কি করবি বাচ্চা মেয়ে!”
“এই সবসময় বাচ্চা বাচ্চা বলবি না তো!” ফোঁস করে ওঠে হেনা
“আমার তো রুম নম্বরটাও মুখস্থ করে ফেলেছে দেখলি তো!”
“থাম, মাথা গরম করে কিছু করার এটা ব্যাপার নয়.. যা করার যথেষ্ট ভেবেচিন্তে করতে হবে। কাগজটা পড়ে এতোটুকুন তো বুঝতেই পেরেছি সকলে.. যে বা যারা এটা রঞ্জুর ব্যাগে দিয়েছে সে আমাদের ব্যাপারে সবকিছু জানে। কে কি করি শুধু সেটা নয়, এখন আমাদের জীবনে কি চলছে, কোথায় যাই.. সব তার নখদর্পনে। নামের আদ্যক্ষর মজা করে লিখেছে, আমার বিশ্বাস পুরো নামগুলোই জানে। এখন কথা হল, যেই হোক না কেন.. তার আমাদের সাথে কি দরকার? এতো লোক থাকতে হঠাৎ আমাদের পিছনে কেন?? তোদের কারুর কিছু মাথায় আসছে? যা বলবি, ঠান্ডা মাথায় বল। রাগ করলে কিন্তু ফল কিছু হবে না!”
এতো অব্ধি বলে জিজ্ঞাসু চোখে বাকি সকলের দিকে তাকায় যূথিকা। নিজেদের কথা বলার মধ্যে আরো দুজোড়া চোখ যে তাদের দিকে অনেক্ক্ষণ থেকে নজর রেখেছে, তা আর পঞ্চরত্নের চোখে পড়ে না।।
(ক্রমশ)