স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বর্ধমানের প্রিয়াঙ্কা
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
বাড়িতে বসে কেক, কুকিস, চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি তৈরি করেও যে স্বনির্ভর হওয়া যায় এবং অপরকে স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখানো যায় তার প্রমাণ রেখে চলেছেন বর্ধমানের মেয়ে ও ভাতারের গৃহবধূ প্রিয়াঙ্কা ঘোষ।
বাবা তার আদরের মেয়ে প্রিয়াঙ্কাকে হাত খরচের জন্য টাকা দিলেও তার স্বপ্ন ছিল নিজে উপার্জন করা, স্বাবলম্বী হওয়া । নিজের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য কার্যত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই শুরু করে দেন গৃহ শিক্ষকতার কাজ। ছাত্র ছাত্রীদের কাছে প্রথম মাসের বেতন পেয়েই খুশিতে ভরে ওঠে তার মন। হোক না সামান্য, তবুও তো নিজের পরিশ্রমের উপার্জন। সে চেয়েছিল নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে দুস্থদের পাশে দাঁড়াতে। এইসব ভাবতে ভাবতেই তার বিয়ে হয়ে যায়। ভেবেছিল এখানেই হয়তো তার স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটল। একরাশ দুশ্চিন্তাকে মাথায় নিয়ে স্বামীর হাত ধরে শশুর বাড়িতে পা রাখে নববধূ প্রিয়াঙ্কা। অচিরেই তার ভুল ভেঙে যায়। শশুর, শাশুড়ি এবং স্বামী তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাকে উৎসাহ দেয়।
বিয়ের পর স্বামীর কর্মসূত্রে প্রিয়াঙ্কা গিয়ে ওঠে স্বামীর কর্মক্ষেত্র দমদমে। চাকুরে স্বামী হাত খরচের টাকা দিলেও সে নিজেও আয়ের উৎস সম্পর্কে ভাবতে শুরু করে। পুরনো অভ্যেস গৃহ শিক্ষকতার কাজ শুরু করে দেয়। কিন্তু এখানেই সে থেমে থাকতে চায়নি। সে চেয়েছিল নিজে উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে অপরকেও উপার্জনের পথ দেখাতে।
হঠাৎ একদিন সমাজ মাধ্যমে একটা বিজ্ঞাপনে তার চোখ আটকে যায়। লেখা আছে 'এখানে হাতে কলমে কেক, কুকিস, চকলেট, আইসক্রিম তৈরি করা শেখানো হয়।' স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর প্রিয়াঙ্কা পরশপাথরের সন্ধান পায়। স্বামী গণেশের সঙ্গে পরদিনই হাজির হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট জায়গায়। শুরু হয় প্রিয়াঙ্কার নতুন করে পথ চলা।
কেক, কুকিস, চকলেট, আইসক্রিম প্রতিটি 'আইটেম' সে মনোযোগ সহকারে শিখতে শুরু করে এবং অল্প সময়ের মধ্যে পদ্ধতিগুলো আয়ত্ব করেও ফেলে।
তারপর বাজার থেকে উপাদান সংগ্রহ করে বাড়িতেই তৈরি করতে শুরু করে কেক। স্ত্রীর তৈরি কেকের প্রথম স্বাদ গ্রহণ করে স্বামী গণেশ তো খুব খুশি। মৃদুভাষী গণেশের বক্তব্য – ভাবতেই পারিনি প্রিয়াঙ্কা এত সুন্দর কেক তৈরি করতে পারবে। প্রথম দু’টো বছর বাড়িতে বসেই চলে অনুশীলনী। ইতিমধ্যে দমদমে অনেকের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে। তাদেরকেও এইসব আইটেম তৈরি করা শেখানোর ইচ্ছে জাগে। সবার উৎসাহে দমদমে নিজের বাড়িতেই শুরু হয় ‘ইয়াম ইয়াম প্রিয়াঙ্কা’ পাঠশালা। ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় সামান্য ফিস। দাদা-বৌদির আমন্ত্রণে প্রিয়াঙ্কা বর্ধমানে বাপের বাড়িতেও তার প্রতিষ্ঠান শুরু করে। ধীরে ধীরে ছাত্র ছাত্রী বিশেষ করে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।
দমদম এবং বর্ধমান – দু’জায়গাতে প্রিয়াঙ্কার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। গত তিন বছর ধরে সুপ্রিয়া, দোয়েল, মৌমিতার মত প্রায় চার শতাধিক মেয়ে এই প্রতিষ্ঠান থেকে কেক, কুকিস, চকলেট, আইসক্রিম তৈরি করা শিখে বিকল্প আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছে। সুপ্রিয়া বললেন – উৎসব বাড়িতে যেমন কেক, আইসক্রিম সরবরাহ করি তেমনি বাড়িতেই ছোটখাটো একটা দোকানও তৈরি করেছি। প্রিয়াঙ্কা দিদির হাত ধরে স্বনির্ভরতার পথ খুঁজে পেয়েছি।
চলার পথে উৎসাহ ও প্রেরণা দেওয়ার জন্য শশুর-শাশুড়ি, মা-বাবা এবং সর্বোপরি স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আটপৌরে বাঙালি গৃহবধূ প্রিয়াঙ্কা বলেন – নিজের অবসর সময় অলস ভাবে না কাটিয়ে সামান্য পরিশ্রমে যদি কিছু আয় হয় ক্ষতি কি? কেক, কুকিস, চকোলেট, আইসক্রিম তৈরির খরচ কম। আবার বাজারে চাহিদাও আছে। সারাবছর অল্পস্বল্প আয় হলেও জন্মদিন বা বিয়ের সিজনে অতিরিক্ত আয় হয়। মেয়েদের স্বনির্ভরতার পথ দেখায়। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে সেটাই বা কম কিসের? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন প্রিয়াঙ্কা।