বিচিত্র বিষয় বিশ্লেষণের উদার পরিসর প্রদান করেছে
সঞ্চলিতা ভট্টাচার্য
উদার আকাশ এমন এক পত্রিকা যা একাধারে বিশেষজ্ঞ সংজ্ঞায়িত গবেষণা পত্রিকা এবং জনপ্রিয় সাময়িকপত্র। ৪৭তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত এর বিশেষ সংখ্যা বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এই সংখ্যায় একদিকে যেমন আলোচিত হয়েছেন দেশ ও বিদেশের স্মরণীয় ব্যক্তিত্বরা, তেমনই সাহিত্য, সঙ্গীত, নাট্য ও চলচ্চিত্রের মতো সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন দিক নিয়ে চর্চা পত্রিকাকে সমৃদ্ধ করেছে। সাম্প্রতিক সমাজ ও রাজনীতির পাশাপাশি রয়েছে দর্শন, লোকজীবন, পরিবেশ ও ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন বিষয়। তথ্যনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধের সঙ্গে উদার আকাশের পরিসরে স্থান পেয়েছে পুস্তক পর্যালোচনা, গল্প, কাব্য এবং উপন্যাসও।
বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের সার্ধশতবর্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে পত্রিকার এই সংখ্যা। মইনুল হাসানের প্রবন্ধ ফজলুল হকের বহুমুখী প্রতিভার ওপর আলোকপাত করেছে। তাঁর শিক্ষাজীবন থেকে রাজনৈতিক ভাবনা, আইনজীবী হিসেবে দক্ষতা, কৃষক-কল্যাণের লক্ষ্যে সমবায়-আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা এবং সর্বোপরি একজন জাতীয়তাবাদী, মানবদরদী দার্শনিক হিসেবে তাঁর জীবন ও চিন্তাকে তুলে ধরেছে এই প্রবন্ধ। আলোচনায় উঠে এসেছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম সহ এদেশের বিভিন্ন মনীষীদের সঙ্গে ফজলুল হকের সম্পর্ক ও ভাবগত আদান-প্রদানের কথাও। আবার মোশারফ হোসেনের প্রবন্ধ বিশেষ করে আজকের দিনে ফজলুল হকের কর্ম ও চিন্তার তাৎপর্যকে তুলে ধরেছে। তিনি লিখেছেন, সাহসী ও মানবিক শের এ বাংলা ফজলুল হক আজও এক আদর্শ পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ফজলুল হকের জীবনের অনুসরণীয় দিকগুলি তিনি তুলে ধরেছেন। কুমারেশ চক্রবর্তীও মহামেডান ফুটবলার কৃষক-বন্ধু বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক প্রবন্ধে অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে ফজলুল হকের বিস্তৃত কর্মজীবনকে স্মরণ করেছেন। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের প্রতীক থেকে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ভূমিকা স্মরণ করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। পাশাপাশি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খেলাধূলায় ফজলুল হকের প্রগাঢ় অনুরাগকেও লেখক তুলে ধরেছেন।
সমীর ঘোষ স্মরণ করেছেন নির্ভীক ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষকে। রূপদর্শীর সাহিত্যিক জীবন সংক্ষেপে আলোচিত হলেও এই প্রবন্ধের মূল বিষয় গৌরকিশোর ঘোষের রাজনৈতিক চিন্তা এবং সত্যনিষ্ঠ সংবাদচর্চা। এর বিপরীতে তিনি তুলে ধরেছেন বর্তমান সংবাদমাধ্যগুলির শাসকের পদলেহনকারী ভূমিকার সমালোচনাও। হাল রাজনীতির মূল্যবোধহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা ও দস্যুয়ায়ণের বিপরীতে ক্ষীণ হয়ে আসা জনকল্যাণমুখী এবং যুক্তিবাদী রাজনৈতিক চর্চার ধারাটিকে তুলে ধরার আবেদনও খুঁজে পাওয়া যায় এই রচনায়।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের মিলনক্ষেত্র আমাদের ভারতবর্ষ। বহুত্ব এদেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এনে দিয়েছে সংমিশ্রণের স্বাদ। ভারতীয় সঙ্গীতে এই ধর্মীয় সমন্বয়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন জয়ন্ত ঘোষাল তাঁর ভারতীয় সঙ্গীত-সংস্কৃতিতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যসাধনা প্রবন্ধে। জসিমউদ্দিনের কবিতার উদাহরণের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন একটি বিশেষ ধর্মকে কেন্দ্র করে জন্ম নেওয়া উৎসবও কিভাবে কালক্রমে ধর্মীয় প্রাসঙ্গিকতাকে ছাপিয়ে সাম্প্রদায়িক ঐক্য উদযাপনের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। বৈদিক যুগ থেকে সঙ্গীতের বিবর্তনের ইতিহাসকে সংক্ষেপে আলোচনা করে লেখক দেখিয়েছেন যে আজ আমরা এদেশের সঙ্গীত বলতে যা বুঝি তাকে সুলতানি-মুঘল যুগের সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের প্রভাব বাদ দিয়ে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। লেখক বোঝাতে চেয়েছেন ধর্মের নিরিখে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ও দূরত্বের চর্চা আসলে এদেশের ঐতিহ্যের বিপরীত। তা না হলে আমাদের সংস্কৃতি কখনওই এতটা পরিণত হতে পারত না। তাই প্রকৃত অর্থে ভারতীয় সংস্কৃতিকে সম্মান জানাতে চাইলে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ঊর্ধ্বে ঐক্য ও মানবতার শিক্ষাকে গ্রহণ করা জরুরি। সুফি ধর্মের সমন্বয়বাদের আদর্শকে পত্রিকার পাতায় তুলে ধরেছেন শামিম আহমেদ তাঁর ভারতীয় সুফি ঐতিহ্য প্রবন্ধে।
পত্রিকার এই সংখ্যায় হাফিজুর রহমান কলম ধরেছেন প্রান্তিক মানুষের অধিকারের দাবিতে। স্টেশন টার্মিনাসে হাটে বন্দরে ধুলোয় পড়ে থাকেন যাঁরা, ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য পথ চলতি মানুষদের কাছে প্রার্থনা করেন সাহায্যের হাত, তাঁরা স্বচ্ছল মানুষের কাছে পরিচিত ‘ভিখারি’ নামে। এই নিরন্ন মানুষদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান জোগান দেওয়া যে রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব হওয়া উচিত, সেকথা স্মরণ করিয়েছেন লেখক।
বাংলার নবজাগরণে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কাব্যচর্চা ও সাংবাদিকতার ভূমিকাকে তুলে ধরেছেন রণজয় মালাকার। মহম্মদ আসিফ ইকবাল ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ শিরোনামে স্মরণ করেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণাদানের ভূমিকায় বিদ্রোহী কবির অগ্নিলেখনীকে। আবার চলচ্চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বহুমুখী দক্ষতার সঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গীতপ্রতিভা যুক্ত হয়ে পথের পাঁচালীকে কিভাবে বিশ্বের দরবারে সমাদর এনে দিয়েছে সেই আলোচনাই করেছেন মধুবন চক্রবর্তী ‘পথের পাঁচালী ও সঙ্গীত’ শীর্ষক প্রবন্ধে। বাংলাদেশের চলচিত্রে দেশভাগের অভিঘাত সম্পর্কে লিখেছেন চৈতী চক্রবর্তী। সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনী স্মরণ করেছে কবি শঙ্খ ঘোষকে।
সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহে মজনু শাহর বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ইতিহাস মনে করিয়েছে রফিক আনোয়ারের প্রবন্ধ। পত্রিকার ইসলাম চর্চা বিভাগে রয়েছে মহিউদ্দিন সরকারের প্রবন্ধ শয়তানের শয়তানি চেনার উপায়। দেবাশিস পাঠক দ্বিতীয় মহসীন শীর্ষক রচনায় সম্মান জানিয়েছেন এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীশিক্ষার উদ্যোগপতি সমাজসেবী মোস্তাক হোসেনকে। গোলাম রাশিদের প্রবন্ধও মোস্তাক হোসেনের কর্মপরিধিকে তুলে ধরেছে। এই সংখ্যায় রয়েছে পুস্তক পর্যালোচনাও। মীরজাফর ও অন্যান্য নাটক বইয়ের আলোচনা করেছেন সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়। দেখিয়েছেন ব্রাত্য বসুর তিনটি নাটক কিভাবে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে শেখায়। ইসলামের পরিচয় গ্রন্থের পর্যালোচনা লিখেছেন জহির উল ইসলাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা গ্রন্থের দার্শনিক ভাবনার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন আলাউদ্দিন মণ্ডল। আবার পাঠকের কলমে উদার আকাশের পূর্ববর্তী সংখ্যার পর্যালোচনাও প্রকাশিত হয়েছে এই সংখ্যায়। পৃত্থীশ রানার নাটক এবং আমিনুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কে আলোচনা স্থান পেয়েছে পত্রিকায়। কাজী খায়রুল আনাম চমকপ্রদ তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ লিখেছেন।
একগুচ্ছ গল্প, অনুগল্প, উপন্যাস ও প্রায় আশিজন কবির কবিতার পাশাপাশি উদার আকাশের এই সংখ্যায় রয়েছে শান্তনু প্রধান ও শুভেন্দু মণ্ডলের সমীক্ষা-নিবন্ধ যথাক্রমে নগরায়ণবাদ-নব্যনগরায়ণবাদ এবং পরিব্রাজন তত্ত্বে নদী-ভাঙনের স্বরূপ। রয়েছে মিতালী সরকারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত সাত প্যাগোডার দেশ মহাবলীপুরম। সংকলিত হয়েছে ইতিহাস গবেষক খাজিম আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার। এই গবেষণা পত্রিকা আলোচনা পরিধির নিরিখে সার্থকনামা। বহুকৌণিক দৃষ্টি দিয়ে স্বদেশ ও বিশ্বের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি, বিজ্ঞান ও পরিবেশ প্রভৃতি বিচিত্র বিষয় বিশ্লেষণের উদার পরিসর গঠনের কৃতিত্বের অধিকারী অবশ্যই সম্পাদক ফারুক আহমেদ।
উদার আকাশ
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা সংখ্যা ১৪৩০
জানুয়ারি ২০২৪,
সম্পাদক ফারুক আহমেদ,
ঘটকপুকুর, পোস্ট ভাঙড় গোবিন্দপুর-৭৪৩৫০২,
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা,
যোগাযোগ: +৯১ ৭০০৩৮২১২৯৮
মূল্য: ২০০ টাকা।