ছোটন ঘোষ,(অধ্যাপক ও পশু চিকিৎসক)
বিষ্ণুপুরে তখন মল্ল রাজার আমল। আনুমানিক সতেরোশো খ্রিষ্টাব্দ। বর্গীদের আক্রমণ ও লুটপাট চলছে। সেই লড়াইয়ে হুগলির সেনাই অঞ্চলের শ্রী বানেশ্বর ঘোষ লাঠি হাতে লড়াই করতে করতে প্রাণত্যাগ করেন। তাঁর দুই তরুণ পুত্র কৃষ্ণকান্ত ও পরান রণক্লান্ত, আহত শরীর নিয়ে প্রায় সত্তর কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পাত্রসায়েরের খোসালপুর গ্রামে এসে পৌঁছান।বসতি স্থাপন করেন।এইভাবে ঘোষ পরিবারের সূচনা হয়। পবিত্র কালীবাঁধ পুস্করিনীর পাড়ে অশ্বত্থ গাছের ঘন ছায়ায় ছিলো বাবা কালাচাঁদ এর অধিষ্ঠান। জায়গাটা ঘন জঙ্গলে পূর্ণ, দিনের বেলাতেই লোকজন যেতে ভয় পেতো।গা ছমছমে পরিবেশ।প্রতিদিন ঠিক সন্ধ্যেবেলায় পরিবারের লোকেরা দেখতে পায়, কোথা থেকে এক কপিলা গাই এসে বাবার মাথার কাছে এসে দাঁড়ায় আর তার দুধের বাঁট থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে দুধ বাবার মাথায় পড়ে। কিছুক্ষন থেকে সেই কপিলা গাই আবার ফিরে যায় অজানা পথ দিয়ে। এছাড়া প্রতি মধ্য রাত্রে (রাত্রি12 টায়) কালাচাঁদ তলা থেকে গ্রামের বাইরে বারভূঁইয়া তলা পর্যন্ত ঘোড়া ছোটানোর শব্দ, ধুলো ঝড়ের শব্দ পাওয়া যেতো।বাবার থান ধুলোর ঝড়ে ভরে যেতো। এই অলৌকিক ঘটনায়, শ্রদ্ধায় ও ভয়ে ঘোষ পরিবার ওই দিকে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এক রাত্রে বাবা কালাচাঁদ পরান ঘোষের স্ত্রী কে স্বপ্নাদেশ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন। তাঁকে ঘোষ পরিবারের দ্বারা পুজো করার নির্দেশ দেন।বাবার আশীর্বাদে ঘোষ বংশের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়বে।পরান ঘোষের স্ত্রী পরদিন সকালে কালীবাঁধে স্নান করে বাবার থানে প্রণাম করে বলেন তারা কিভাবে পুজো করবেন? কিছুই তো জানেন না বাবার পুজো আর্চার বিষয়ে, সামর্থ্য ও নাই।বাবা স্বপ্নাদেশ এ জানালেন যে, রান্নার জন্যে বাঁশের টোকায় করে যে সেদ্ধ চাল তুই পুকুরে ধুতে আসিস, সেখান থেকেই মাত্র দুছটাক অর্থাৎ দুমুঠো দিয়েই যেনো তাঁকে নিত্য পুজো করা হয়।পুজোর সেই প্রাচীন রীতি এখনও চলে আসছে। কোনোপ্রকার আড়ম্বর ছাড়াই সারা বছর ধরে দুছটাক সেদ্ধ চালের নিত্যসেবা করে ঘোষ পরিবার। পরিবারের বরিষ্ঠ সদস্য শ্রী অসিত ঘোষ জানান, পৌষের মকর সংক্রান্তির পূণ্য লগ্নে এর ব্যতিক্রম ঘটে। বাবার নির্দেশে ঘোষ পরিবার মহা ধুমধাম করে এই দিন পুজো করে। বাবার নির্দেশে এই দিন খোসালপুর গ্রাম, আশেপাশের গ্রামের মানুষজন ভোগ প্রসাদ খান। বাবার ভোগ প্রসাদে খিচুড়ি, পরমান্ন ও অন্যান্য পদ রান্না হয়। আশে পাশের গ্রাম জুড়ে উৎসবের চেহারা নেয়। গ্রামে সেদিন অরন্ধন পালন হয়, উনুন জ্বালানো হয় না।এদিন সকলেই প্রসাদ পায়, বাবার নির্দেশে কাউকে ফেরানো হয় না।হাজার দুয়েক ভক্ত প্রসাদ পায়। ভক্তের সংখ্যা বাড়লেও বাবার মাহাত্ম্যে প্রসাদ কমেও না, নষ্ট ও হয় না। পরিবারের তরফে অধ্যাপক (ডা:) ছোটন ঘোষ জানান, এই প্রথা বাবা কালাচাঁদ শুরু করিয়েছিলেন কারণ সেই সময় মানুষের ভীষন অভাব ছিলো,তাই এই একটা দিন ও যেনো প্রত্যেকে পেট ভরে মনের সুখে খেতে পারেন। আজকের মূল্যবৃদ্ধির দিনে একটা পরিবারের তরফ থেকে এত ভক্তদের খাওয়ানো বাবার আশির্বাদ ছাড়া সম্ভব হতো না। শ্রী নবরুপ ঘোষ জানান এই প্রথা আগামী দিনেও চালু থাকবে, বন্ধ করা হবে না কোনোদিন। বাবার অধিষ্ঠান গাছ তলায়।পরিবারের উদ্যোগে প্রথমবার 1990 সালে মন্দির বানানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যতবারই দেওয়াল তোলা হয়, আশ্চর্যজনক ভাবে রাত্রে তা ভূপাতিত হয়। বাবা ক্রুদ্ধ হন ও স্বপ্নাদেশ এ মানা করেন। বাবার অষ্ঠধাতুর মূর্তি যা প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের শেকড়ের নিচে গভীরে চাপা পড়ে আছে।1970সালে প্রথম এই মূর্তি চুরির উদ্দেশ্যেএকদল দুষ্কৃতী মূর্তি হাতে নিয়ে সাময়িভাবে অন্ধ হয়ে যায়,মূর্তি যথাস্থানে রাখার পর তারা আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।এই মূর্তি অমূল্য।এই পরিবারের দুই প্রয়াত সদস্য তাদের ছোটবেলায় তারা বাবার থানে ঘড়া ঘড়া রৌপ্য মোহর দেখতে পায়, তারা দৌড়ে বাড়িতে এসে বাবা মা কে ডেকে আনে, যখন সবাই ফিরে আসে, কিছুই দেখতে পায় না। গ্রামের সবাই জানে বাবার থানে অমূল্য ধন, মোহরের কলস পোঁতা আছে। ঘোষ পরিবারের অনেককেই বাবা স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন,ঘোষ পরিবারের যে সদস্য হাতে ছয় আঙ্গুল নিয়ে জন্মাবে,এই গুপ্তধন সেই পাবে। মল্ল রাজারা বাবা কালাচাঁদ এর ভক্ত ছিলেন, বাবার মাহাত্যের খুব খোঁজখবর রাখতেন। তাঁরা খোসালপুরের ঘোষ পরিবারকে খুব স্নেহ করতেন।