পালিত হলো কাহার পত্রিকার পঞ্চম বর্ষ পূর্তি উৎসব,
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
ভারত এমন একটা দেশ যার প্রতিটি প্রান্তে লুকিয়ে আছে একটা আঞ্চলিক ইতিহাস, সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি। এই স্হানীয় বৈশিষ্ট্য তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রেখেছে, একটা আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে । পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। রাজ্যের কোণে কোণে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য অজানা বৈশিষ্ট্য। শুধু আধুনিকতার যাঁতাকলে আক্রান্ত হয়ে নয় বিভিন্ন কারণে নিজের এলাকার ইতিহাস সম্পর্কে অনেক সময় বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ দেখা যায়না। এখনও অনেকেই নিজের গ্রামের নামকরণের ইতিহাস বা গ্রামের বিদ্যালয় গড়ে ওঠার কারণ সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। অনেকেই জানেনা তাদের গ্রামই ছিল ইংরেজদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া বিপ্লবীর জন্মভিটে। সাধক-কবি নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় নিজ এলাকাতেই অপরিচিত। এভাবেই ধীরে ধীরে অনেক ইতিহাস, সংস্কৃতি বিষ্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে। অথচ এই ইতিহাসই মানুষের চলার পথে বড় প্রেরণার সৃষ্টি করে। ইতিহাস যাতে চিরকালের জন্য হারিয়ে না যায় তার জন্য একদল 'পাগল' গবেষক 'ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর' এর মত তন্ন করে খুঁজে বেড়ান সেই ইতিহাস। নিজেরা তো সমৃদ্ধ হনই তেমনি অন্যদেরও সমৃদ্ধ করেন। সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্যই আঞ্চলিক ইতিহাস 'পাগল' প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে পাঁচ বছর আগে যাত্রা শুরু করে ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা 'কাহার'। সেদিনের মত আজও পাশে আছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নারায়ণ চন্দ্র গড়াই, শুভঙ্কর চ্যাটার্জ্জী, সবিতাব্রত লাহা, স্ত্রী টিনা সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
একঝাঁক গবেষক, সাহিত্যিক, প্রশাসনিক আধিকারিক, সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং হলভর্তি দর্শকদের উপস্থিতিতে গত ১১ ই নভেম্বর গুসকরা বিদ্যাসাগর হলে 'কাহার' পত্রিকার পঞ্চম বর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। প্রসঙ্গত গত পাঁচ বছর ধরে গবেষণাধর্মী আঞ্চলিক ইতিহাস, সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে কাহার পত্রিকা আগ্রহী পাঠকের মনে বিশেষ স্হান অধিকার করে নিয়েছে।
অনুষ্ঠানে লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার সম্ভাবনা ও সমস্যার মত গুরুগম্ভীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোগ্রাহী আলোচনায় অংশ নেন শিবশঙ্কর ঘোষ, ডঃ সর্বজিত যশ, ডঃ শম্পা রাউত, ভব রায়, প্রণব ভট্টাচার্য প্রমুখ। তাদের তথ্য সমৃদ্ধ ভাবগম্ভীর আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যমাত্রা এনে দেয়।
অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী তনুজা সিংহ মুখোপাধ্যায়। সুপরিচিত বাউল শিল্পী মানস মুখোপাধ্যায়ের মন উদাস করা বাউল গান হলে উপস্থিত শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেয়। চাদর বাধনি, ঘোড়া নাচের মত এক সময়ের জনপ্রিয় অথচ বর্তমানে লুপ্তপ্রায় আদিবাসী লোক সংস্কৃতি পরিবেশন করেন আউশগ্রামের আদিবাসী শিল্পীরা। উৎপল বেসরার 'ভৌরয়ৌ'- ব্যান্ডের গান উপস্থিত শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দেয়।
এর আগে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে উৎসবের শুভ সূচনা করেন পূর্ব বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) সুপ্রিয় অধিকারী। উৎসবে কাহার পত্রিকার বিশেষ আদিবাসী সংখ্যার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সহকারী সভাধিপতি দেবু টুডু এবং কাহার পত্রিকার ওয়েবসাইটের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন আউশগ্রামের বিধায়ক অভেদানন্দ থান্দার।
উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে 'কাহার গোপভূম রত্ন পুরস্কার' প্রদান করা হয় বিশিষ্ট আঞ্চলিক বিষয়ক গবেষক তথা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ডঃ বলরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, 'কাহার সারস্বত সম্মান' প্রদান করা হয় সুপ্রিয় অধিকারী, 'ভৈরবচন্দ্র পীট' স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয় বিশিষ্ট মানভূম গবেষক সুভাষ রায়, কাহার সাহিত্যকৃতি' সম্মান প্রদান করা হয় শিশু সাহিত্যিক মহঃ মোজ হারুল হামিদ, কবি 'মুক্তিপদ চক্রবর্তী' স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয় কবি আসিকার রহমানকে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মঙ্গলকোটের বিডিও জগদীশ চন্দ্র বাড়ুই, পূর্ব বর্ধমান জেলার ডিএসপি (ডিএনটি) সৌরভ চৌধুরী, জেলা পরিষদের সদস্য সফিউল আলম মন্ডল, গুসকরা পুরসভার প্রশাসকমন্ডলীর সদস্য কুশল মুখোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন মেডিকেল কলেজের কর্ণধার তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী মলয় পীট সহ অসংখ্য আঞ্চলিক ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। এলাকায় হাতি প্রবেশ করার জন্য ইচ্ছে থাকলেও উপস্থিত থাকতে পারেননি আউসগ্রাম ১ ও ২ নং ব্লকের বিডিও অরিন্দম মুখোপাধ্যায় ও গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়। দুজনেই অনুষ্ঠানের সাফল্য কামনা করেছেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা তথা কাহার পত্রিকার সম্পাদক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ছোট বয়স থেকেই আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রতি তার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে গেলেই সেখানকার ইতিহাস, সংস্কৃতি বা সাহিত্য বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করতেন। অনেকের কাছে সেটা পাগলামি বলে মনে হলেও প্রদীপ বাবু হতাশ না হয়ে লেখালেখি শুরু করেন। কিন্তু অন্যের পত্রিকায় লিখতে গিয়ে অনেক সময় নিজের মনতৃপ্তি হয়নি। তাই পাঁচ বছর আগে নিজেই শুরু করেন 'কাহার' পত্রিকা। উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এবং অনিবার্য কারণে যারা উপস্থিত থাকতে পারেননি তাদের প্রত্যেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রদীপ বাবু বলেন - আশাকরি আজকের অনুষ্ঠানের আলোচনা সভা থেকে সমৃদ্ধ হয়ে এলাকাবাসীরা নিজ নিজ এলাকায় লুকিয়ে থাকা ইতিহাস খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হবেন এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সেগুলি তুলে ধরবেন। আজকে যারা উপস্থিত থাকতে পারেননি ভবিষ্যতে তাদের উপস্থিতি তিনি কামনা করেন।