উড়ান
(পর্ব- ১৪/ অন্তিম পর্ব),
দেবস্মিতা রায় দাস,
পালককে আবার হোটেলে ফিরিয়ে আনা হলে সকলে তাকে দেখতে এল। চোখ মুখ বসে গেছে, খুবই রুগ্ন লাগছে তাকে। সকলেরই মুখ থমথমে, এতোটা খারাপ পরিস্থিতি কেউ আশা করে নি। জিৎ সবসময় তার পাশে পাশে ছিল। সে বোধহয় নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল একদম প্রতিযোগিতা শেষ হওয়া অবধি পালককে কাছছাড়া করবে না।
বাকিদের সাথে স্যাম একটা লাস্ট ক্লাসে বসল। পালককে কেবল একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ব্যথিত কন্ঠে বলল….
“তোমায় আর বিশেষ কিছু বলার নেই পালক.. যা যুদ্ধ তুমি পার করে এসেছো, তাই তোমায় সব শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে। মনের জোরে ভর করে তুমি স্টেজে উঠবে, আর মনে করবে কিছুক্ষণের জন্য এই স্টেজটা শুধু তোমার, আর কেউ নেই এখানে। কেউ বলে দেওয়ার নেই কিছু.. তোমার যা ভিতর থেকে আসে, যা ঠিক মনে হয় সেটাই বলবে। মনে রাখবে এখানে হারানোর কিছু নেই। শুধু তোমার বেস্টটুকু দিয়ে কিছু মুহুর্ত তুমি কেড়ে নিয়ে যাবে তোমার সাথে!”
পালক অল্প হেসে ঘাড় নাড়লো একটু। হ্যাঁ সত্যিই তো হারানোর কিছু নেই। যা যা হয়েছে তার সাথে, আর কি নতুন করে হারানোর কি আছে? তাই আজই সময় তার সবটুকু দিয়ে কিছু নতুন করে পাওয়ার, যা তাকে আগে এগিয়ে নিয়ে যাবে,, দেবে নতুনভাবে বাঁচার রসদ।।
দুপুর নাগাদ পালক একটু উঠে বসতে পারলো সকাল থেকে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর।
সন্ধ্যা সাতটা থেকে প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার কথা। দুপুরের পর থেকেই পালক মনোনিবেশ করল তার নিজের জগতে। আগে একটু মেডিটেট করে নিজের মনকে একত্রিত করেই শুরু করল আবার সেই অডিও ক্লিপ শোনা। বেশ অনেক্ষণ শোনার পর একবার দুঃস্বপ্নের মতো তার সেই রাতের কথা মনে পড়ে চোখে মুখে একটা ভয়ার্ত আবহের ছাপ পড়তেই টের পেল দুদিক থেকে দুটো হাতের ছোঁয়া তার হাতের উপর, জিৎ আর মীরা। পলকে তার ভয় উধাও হয়ে মনের মধ্যে আবার শান্তি খুঁজে পেল। ঈশ্বরকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালো এমন দুজন বন্ধুকে পাশে পেয়েছে বলে।
স্টেজে ওঠার অভিজ্ঞতা তার নেই, কিন্তু স্থির করল আজ তাকে যেই বিষয়ই দেওয়া হোক না নির্ভীকভাবে নিজের মনের মতোন করে তার সবটুকু দিয়ে বলবে সে।
বিকেল থেকেই সাজো সাজো রব পড়ে গেল হোটেলে। পালককে আজ মীরা নিজের হাতে সাজিয়ে দিল। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বলে ফ্রেন্ডস হাইফাইভ এফ এমের তরফ থেকে তাদের দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী মেয়েদের শাড়ি ও ছেলেদের পাঞ্জাবি পরা স্থির হয়েছিল। একটা সোনালী পারের অফ হোয়াইট কালারের সিল্ক শাড়িতে পালককে অবর্ণনীয় সুন্দর লাগছিল। সাদা রঙটা পালকের এমনি খুব পছন্দের। একটা অদ্ভুত শ্রদ্ধা জাগছিল তাকে দেখে। একটা ম্যাজেন্টা রঙের শাড়িতে মীরাকেও বেশ মিষ্টি লাগছিল। কিন্তু মীরা সহ বাকি সকলেরও চোখ তখন শুধু পালকেরই দিকে। জিৎএর সর্ব সময়েই ভালো লাগে পালককে, আজ যেন তার চোখে এক অন্য ভালোলাগা। রীনা ম্যাডাম তার চিবুক ধরে কপালে চুমো খেলেন আর অনেক আশীর্বাদ করলেন।
প্রতিযোগিতায় প্রথম দ্বিতীয় এবং তৃতীয় যারা হবে তাদের সাথে চুক্তি হবে এই আন্তর্জাতিক সংস্থার আর প্রত্যেকে পাবে পঞ্চাশ লাখ টাকার একটি গিফট চেক। চুক্তি অনুযায়ী দেশে বিদেশে ঘুরে বিভিন্ন বড়ো বড়ো জায়গায় এনকরিং বা শো করে বেড়াবে তারা, কথা বলার এবং গানের। পালকের কাছে এর থেকে বেশী লোভনীয় আর কিছু হতে পারে না। টাকার উপর তার খুব একটা লোভ না থাকলেও, জীবনে উঠতে গেলে কিছু অর্থের তো প্রয়োজন।
রোহিত রায় আর স্যাম দারুণ ভাবে অনুপ্রেরণা দিলেন সকলকে। শার্যার ইউনিভার্সিটি হল অডিটোরিয়াম দারুণভাবে সেজে উঠেছে প্রতিযোগীদের জন্য। পালকের দারুণ সুন্দর লাগলো জায়গাটা। ভারতের আরো বেশ কয়েকটা চ্যানেল থেকে প্রতিযোগী ছিল। তাদের সুযোগ আসতে আসতে আটটা বেজে গেল। এখানে আর কানে হেডফোন গুজে একটা ঘরে বসে মাইকের সামনে বলা নয়, বিশাল অডিটোরিয়ামে বিপুল সংখ্যক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে মাইকে বলা। প্রত্যেকের সময় দশ মিনিট করে।
মীরা আর রাহুলের পরই পালকের ডাক পড়ল। পালকের শরীর এখনো দুর্বল, তাই তার জন্য একটা বসার চেয়ার দিয়ে দেওয়া হল। বিচারকদের আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তবুও তাদের মধ্যে কারুর কারুর ভ্রু একটু কুঞ্চিত হল। পালক স্টেজের পাশে তাকাতেই রোহিত রায়কে দেখতে পেল। তিনি সাহস রাখতে বললেন।
তাকে বিষয় দেওয়া হল একজন নারীর মধ্যে সৌন্দর্য না মাতৃত্ব, কোনটা বেশী আকর্ষণ করে তাকে?? পালক আগে কিছুক্ষণ চুপ করে চোখ বুজে বসে রইল। তার পরে অত্যন্ত দৃঢতার সাথে বলতে শুরু করল ইংরাজিতে যার বাংলায় অর্থ হল..
“সমবেত সকলকে অভিবাদন জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি। নারী ঈশ্বরের এক অপরূপ সৃষ্টি। একই সাথে শান্তি,শক্তি, বিশ্বাস, মায়া, মমতা, সহনশীলতা, প্রেম, ভালোবাসার এক অপূর্ব আধার। একাধারে তার মধ্যে আছে সর্বস্থানে লড়াই করার ক্ষমতা, সর্বত্র মায়া মমতা স্নেহের প্রকাশ আবার নিজের পেখমকে মেলে ধরার আকুল আকাঙ্খা। কেবলমাত্র সৌন্দর্য বা মাতৃত্বের প্রতীক সে নয়৷ এমন অনেক কিছু তাকে অনেক ক্ষেত্রে ফেস করতে হয়, যা সকলের কল্পনার অতীত। আজ সর্ব ক্ষেত্রেই সার্থক, সফল তারা। গর্বিত করে চলেছে দেশ, শহর এবং পারিপার্শ্বিক সকলকে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তাই আমি মনে করি, নারী কেবল তার নারীত্বেরই প্রতীক.. কেবলমাত্র তার সৌন্দর্যের বা মাতৃত্বের প্রতীক নয়।”
পালকের বক্তব্য শেষ হতেই হাততালিতে হল ফেটে পড়ল। পালক নিজেও এতোটা দৃঢতার সাথে এতো সুন্দর করে বলে উঠতে পারবে ভাবতে পারেনি। তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। স্টেজ থেকে নামার সাথে সাথেই মীরা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। বাকি সকলেও তার প্রশংসামুখর হয়ে উঠল।
রোহিত রায়, স্যাম আর রীনা ম্যাডামের ধারণাকে নিশ্চিত প্রমাণ করে বিদেশের একজনের পরই দ্বিতীয় হিসেবে পালকের নাম শোনা গেল। পালক যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মুখে এক অপার্থিব তৃপ্তির হাসি দেখে বাকিরাও আর চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। রোহিত রায় তার কাঁধে হাত রেখে কেবল বলেন..
“ইউ ডিসার্ভ ইট পালক!!”
পুরষ্কার নিতে উঠে পালকের মনে হল এতোদিনে তার স্বপ্ন বুঝি সফল হল। এতো কষ্ট, লড়াইয়ের ফল বুঝি আজ মিলল। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি, তৃপ্তির আশ্বাস। ওখানে বসেই সাইন করা হয়ে গেল কন্ট্র্যাকটে, আর পেল পঞ্চাশ লাখ টাকার চেক। পালকের চোখে জল, মা তো এইদিনের অপেক্ষাই করতেন সবসময়, কিন্তু নিজের চোখে দেখতে পেলেন না। রোহিত রায় সহ বাকি সকলেও খুব খুশি, পালকের জন্য সর্বত্র এখন তাদের চ্যানেলের সুনাম।
এতো সুন্দর শহরটাকে ছাড়তে বেশ খারাপ লাগছিল পালকের। পরের দিন ফ্লাইটে করে ফেরার পথে পালক আর জিৎ পাশাপাশি বসেছিল। জিৎ একটু পিছনে লাগছিল তার..
“এবারে তো ম্যাডামের পাত্তা পাওয়াই ভার। এপয়ন্টমেন্ট করে দেখা করতে হবে!”
পালক একটা চিমটি কাটলো তাকে..
“একদম না, আমরা চিরকাল একইরকম থাকবো। তোর মতোন এমন বন্ধুকে কাছছাড়া করে কোন পাগল!”
জিৎ এবার একটু অন্যভাবে তাকালো..
“আর যদি বলি বন্ধুত্বের থেকেও অনেক বেশী কিছু চাই তোর থেকে!?”
এবারে পালকের মুখে লালচে আভাস..
“যাঃ, হনুমান একটা!”
পিছনের সীট থেকে মীরা হো হো করে হেসে উঠল।।
সমাপ্ত