ইডির জালে অনুব্রত এবং এরপর বীরভূমের কি হবে?
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
অবশেষে প্রত্যাশা মতই ইডির জালে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা দুর্দান্ত প্রতাপ নেতা ও সংগঠক অনুব্রত মণ্ডল। মূলত গরু পাচার করার অভিযোগে গত ১১ ই আগষ্ট সিবিআই বোলপুরের নিজস্ব বাড়ি থেকে অনুব্রত ওরফে কেষ্টকে গ্রেপ্তার করে। তারপর থেকে আদালতের নির্দেশে এতদিন সে আসানসোলের সংশোধনাগারে বন্দী ছিল। গত ১৭ ই নভেম্বর আদালতের অনুমতি নিয়ে সংশোধনাগারে ইডি তাকে জেরা করে। তার উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে ইডি তাকে গ্রেপ্তার করে নিজেদের হেপাজতে নেয়। শোনা যাচ্ছে তাকে দিল্লিতে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে।
চিটফাণ্ডকে কেন্দ্র করে যেসব তদন্ত চলছে তার ধারাবাহিক ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দ্যাখা যাবে - সিবিআই, ইডি, জেরা, গ্রেপ্তার দীর্ঘদিন পর জামিনে মুক্তি। এটাই চলে আসছে। মাঝখান থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কিছুটা সময় কারাগারের অন্ধকার কক্ষে কেটে যাচ্ছে এবং প্রমাণিত অপরাধী না হয়েও এক শ্রেণির রাজনীতির নেতার কাছে চোর নামে অভিহিত হচ্ছে। এই রাজ্যে এটা খুবই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ফলে এখন আর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়না। প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
অনুব্রত মণ্ডল ছিলেন বীরভূম জেলার সভাপতি এবং এখনো আছেন। একইসঙ্গে অধুনা পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রাম, কেতুগ্রাম ও মঙ্গলকোটের পর্যবেক্ষক ছিলেন। সংগঠক হিসাবে নিজের দক্ষতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন। তার দাপটে একদা লালদুর্গ বীরভূম বা পূর্ব বর্ধমানের তিনটি ব্লক তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে। এখনো বিরোধীরা সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। তার ভয়ে নিজের দলের নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত তটস্থ ছিল। তার এলাকায় দলের রাজ্য নেতৃত্ব ছিল অপাঙক্তেয়। আক্ষরিক অর্থে সেখানে তাদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি দলের সিদ্ধান্ত তিনি অনেক সময় মানতেন না। নিজ এলাকায় তার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। কোনো অজানা কারণে রাজ্য নেতৃত্ব নীরব থাকত। অর্থাৎ কার্যত এই রাজ্যের মধ্যে দু'টো তৃণমূল কংগ্রেস ছিল - একটা অংশের নেতৃত্বে ছিল অনুব্রত মণ্ডল এবং অপর অংশে বাকিরা।
অনুব্রতের সৌজন্যে আউসগ্রাম বা মঙ্গলকোটে এমন কয়েকজন দলের দায়িত্ব পেয়েছিল সাধারণ মানুষের কাছে যাদের গ্রহণযোগ্যতা নাই। দলের দুর্দিনের কর্মীরা চলে যায় পেছনের সারিতে। চঞ্চল গড়াইয়ের মত জনপ্রিয় নেতার করুণ পরিণতি দেখে প্রতিবাদ করতে কেউ সাহস করেনি। পূর্ব বর্ধমানের তিনটি ব্লককে আবার পুরনো জেলার সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য দুর্দিনের কর্মীরা যেমন আশায় বুক বাঁধছে তেমনি অন্যদল বিশেষ করে সিপিএম থেকে আগত নেতারা কিছুটা হলেও মুষড়ে পড়েছে। তাদের আশা ছিল অনুব্রত জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার দায়িত্ব পাবে এবং তারা অতীতের মত দাপট দ্যাখাবে। কিন্তু ইডির হাতে অনুব্রত গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের অনেকেই মনমরা হয়ে পড়েছে।
অনুব্রতর গড়ে বিরোধী বিজেপি বা সিপিএম যে খুব একটা ভাল অবস্থায় আছে সেটা বলা যাবেনা। কারণ দু'টো দলই ধারাবাহিক আন্দোলন থেকে দূরে আছে। নীচু তলার কিছু কর্মীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের বক্তব্য - অনুব্রত ফিরে এলে চাপে পড়ে যাব। তখন অতীতের মত নেতাদের পাশে পাবনা। রাজনীতির মঞ্চে অনুব্রতর অনুপস্থিতির মধ্যেও উপস্থিতি তাদের খুবই চাপে রেখেছে।
ইতিমধ্যে বীরভূমে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের একটা আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। বগটুইয়ের ঘটনার পর থেকেই অনুব্রত যথেষ্ট ব্যাকফুটে। এখন তো পুরোপুরি। আসানসোলে তিনি নাকি বলেছেন - চাঁদু ও বিকাশের কথা শুনে চলতে। এদিকে দল সামনে রেখেছে রাণাকে। দল পরিচালনার জন্য একইসঙ্গে একটা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এখন দ্যাখার অনুব্রতর অনুপস্থিতিতে তারা কতটা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে।
সামনে পঞ্চায়েত ভোট। বীরভূম ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজনীতিতে অনুব্রত ছিল বড় ফ্যাক্টর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপচ্ছন্দ হলেও দলের নেতা-কর্মীরা তাকে ভরসা করত। রাজনীতি বা অন্য কোনো বিষয়ে কেউ অপরিহার্য না হলেও অন্তত এক্ষেত্রে তার দাপটকে অস্বীকার করা যায়না। তাই আপাতত দল তাকে সভাপতির দায়িত্বে রেখে বিরোধীদের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে। এখন দ্যাখার এতেও শেষ রক্ষা হয় কিনা। পঞ্চায়েত ভোটে অটুট থাকে কিনা অনুব্রতর গড়।