আধার কার্ড সংশোধন – এক জীবন যন্ত্রণা
জ্যোতিপ্রকাশ মুখার্জি,
সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রতিটি ভারতবাসীর জীবনের অন্যতম অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে আধার কার্ড। বিকল্প হিসাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের ভোটার কার্ড, র্যাশন কার্ড, ব্যাংকের পাস বই এবং আরও হরেকরকমের সরকারি পরিচয় পত্র থাকলেও আধার কার্ড হয়ে উঠেছে বাধ্যতামূলক । সেগুলি পাওয়ার জন্য নিয়ম মেনে আবেদন পত্র জমা দিতে হয়। ছবি তোলার ব্যাপার থাকলে আর এক টেনশন। কার্যত সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হবে। আধার কার্ডে যে ছবি উঠবে অধিকাংশ গ্রাহক সেটা দেখে আঁতকে উঠতে বাধ্য। এমন ছবি ওঠে যেটা দেখে কার্ডের মালিক নিজেই নিজেকে চিনতে পারেনা। অথচ প্রযুক্তি এখন যথেষ্ট উন্নত। একরাশ মানসিক চাপ সহ্য করে যখন সেগুলো গ্রাহকদের হাতে পৌঁছাবে দেখা যাবে সেখানে একগুচ্ছ ভুল অপেক্ষা করছে। কারও নাম বা পদবীর বানান ভুল, কারও বা ঠিকানায় ভুল। কিভাবে সেই ভুল সংশোধন করা যাবে সেটা ভেবে নতুন করে চাপ বাড়বে। অর্থাৎ সঠিক তথ্য দিয়েও যাবতীয় কাজ ফেলে গ্রাহকদের ছুটে বেড়াতে হবে। কোথায় কিভাবে আধার কার্ড সংশোধন করা হবে সেটা ভেবে সাধারণ মানুষ কুলকিনারা খুঁজে পায়না। অথচ সঠিক আধার কার্ড না থাকলে কোনো সরকারি সুযোগও পাওয়া যাবেনা।
জানা যাচ্ছে বর্তমানে রাজ্য সরকারগুলি এইসব কাজ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্হাকে দিয়ে করিয়ে নেয়। প্রশ্নটা এখানেই উঠতে শুরু করেছে - জনগণের করের টাকা দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি সংস্হাগুলিকে, তাহলে ভুল সংশোধনের দায়িত্ব কেন তাদের দেওয়া হবেনা? কাজের বিনিময়ে তারা অর্থ পাচ্ছে। তাসত্ত্বেও কেন তাদের ভুলের মাশুল সাধারণ মানুষকে গুনতে হবে? কেন পঞ্চায়েত বা পৌরসভার সাহায্য নিয়ে সেগুলি তাদের সংশোধন করতে বাধ্য করা হবেনা? এখানেও কি কোনো অবৈধ আর্থিক লেনদেনের গন্ধ আছে?
প্রতিটি জেলায় হাতে গোনা মাত্ৰ কয়েকটা ব্যাংক ও পোস্টঅফিসে নতুন আধার কার্ড তৈরি ও সংশোধনের কাজ করা হয়। বেশিরভাগ পোস্টঅফিসে অপারেটারের অভাবে সে কাজও প্রায় বন্ধ থাকে । অনেক ব্যাংকে আধারের নামে চলছে জালিয়াতি। ব্যাংকে আধার সংশোধন করতে গেলে অনলাইনে আগে থেকে যোগাযোগ অর্থাৎ অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট করতে হয়। সাধারণত সংশোধনের তারিখ পরে ছয় মাস থেকে এক বছর পর। ফলে মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দালাল ধরে ব্যাংকের নির্দিষ্ট অনলাইন সেন্টারে গিয়ে টাকা দিলেই নাকি আধার সংশোধনের তারিখ পরে তাড়াতাড়ি। টাকার পরিমাণটাও কম নয় - ৪০০-৫০০ টাকা। এই সব অনলাইন সেন্টারগুলোয় জালিয়াতির ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। সবকিছুই চলে প্রশাসনের নাকের ডগায়। কিন্তু প্রশাসন থাকে নীরব দর্শক। দালাল চক্র বা জালিয়াতের বিরুদ্ধে কোনো কঠিন পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য জালিয়াতের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। ভারপ্রাপ্ত সংস্হার দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার জন্য ভুলে ভরা আধার কার্ড নিয়ে চোখে আঁধার দেখছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। বর্তমান জীবনে আধার কার্ড একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও ভুল সংশোধন বা নতুন আধার কার্ড তৈরি করার ব্যাপারে সরকারের যেন কোনো হেলদোল নাই।
কয়েক মাস আগে একটি পোস্ট অফিসে আধার কার্ড সংশোধনের কথা ঘোষণা করা হয়। শুধু সংশ্লিষ্ট ব্লকের নয়, আধার কার্ড সংশোধনের জন্য অন্য ব্লক থেকেও মানুষরা ছুটে আসে। করোনা আতঙ্ককে সঙ্গী করে ভোর থেকেই সেখানে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। বহু মানুষ হতাশ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্যও হয়। লাইনের দৈর্ঘ্য দেখে সহজেই অনুমান করা যায় কি বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে আছে ভুলে ভরা আধার কার্ড। জালিয়াতি বন্ধ করার ক্ষেত্রে আধারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভুলে ভরা আধার কার্ড সংশোধনের জন্য সরকারের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়।
ভুলে ভরা আধার কার্ড সংশোধনের জন্য দীর্ঘ ২-৩ বছর ধরে কার্যত দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মঙ্গলকোটের জনৈক গ্রামীণ ডাক্তার । তার বক্তব্য - ভুলে ভরা আধার কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করুক স্হানীয় পঞ্চায়েত প্রশাসন। তারপর 'দুয়ারে সরকার' এর মত প্রতিটি পঞ্চায়েত ও পৌর এলাকায় 'দুয়ারে আধার কার্ড সংশোধন' এর মত ক্যাম্প করে সেগুলি সংশোধনের ব্যবস্থা করা হোক। এতে সাধারণ মানুষের হয়রানি অনেকটাই কমবে। তার আরও বক্তব্য - যেহেতু বায়ো-মেট্রিক বিষয়টি আগেই হয়ে আছে তাই যেভাবে ভোটার কার্ড সংশোধন করা হচ্ছে সেভাবেই আধার কার্ডের ভুলগুলো সংশোধন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে যেসব সংস্হা ভুল করেছে তাদেরও সংশোধন করতে বাধ্য করা হোক। শুধু উনি নন আরও অনেক ভুক্তভোগীর বক্তব্য প্রায় একই রকম। কারও কারও বক্তব্য সরকার যেন ঠিকই করে নিয়েছে আধার কার্ড সংশোধনের নামে মানুষকে হয়রানি করব।
আধার কার্ডের সঙ্গে যুক্ত জনৈক আধিকারিকের বক্তব্য – যেভাবে আধার কার্ডের ভুল সংশোধন নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের হয়রানির খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে বিষয়টি গভীর ভাবে ভাববার সময় হয়েছে। জেলার মধ্যে মাঝে মাঝে একটা দুটো ব্যাংক বা পোস্ট অফিসের উপর দায়িত্ব না চাপিয়ে আধার কার্ডের ভুল সংশোধনের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রতিটি পঞ্চায়েত ও পৌর এলাকায় এবং পরে প্রতিটি ব্লকে পৃথক দপ্তরের ব্যবস্হা করতেই হবে। নাহলে সরকারি পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে আধার কার্ডের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ব্যর্থ হবে। তাছাড়া যেহেতু আধার কার্ডের বিষয়টি চলমান এবং এখনো অনেকেরই আধার কার্ড তৈরি হয়নি তাই এটা নিয়ে ভাবতেই হবে। যেসব সংস্হাগুলি ভুলগুলো করে চলেছে তাদের কাছেও কৈফিয়ত চাওয়ার সময় হয়েছে। নাহলে সরকারি অর্থ নয়ছয় হবে এবং দিনের পর দিন মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।
এখন দেখার মানুষের অযথা হয়রানি কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আধার কার্ড সংশোধনের ক্ষেত্রে সত্যিই কোনো অর্থবহ ভূমিকা নেওয়া হয় কিনা।