খায়রুল আনাম (সম্পাদক সাপ্তাহিক বীরভূমের কথা)
নেতাজীর বোলপুর আগমনে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে ‘সুভাষবাদ’ ও ‘গান্ধিবাদ’
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু অনেকের কাছে আজও স্বপ্নের রাজপুত্রের মতো। যিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন, আবার কোথায় যেন বিলিন হয়ে গেলেন। আজও অনেক মানুষের মনে এই বিশ্বাসটাই বিরাজ করে যে, তাঁদের স্বপ্নের রাজপুত্র নেতাজী আবার একদিন হয়তো হঠাৎ করেই তাঁদের মাঝে ফিরে আসবেন। সেই স্বপ্ন উড়ানের পথ চেয়ে আজও যেন অপেক্ষায় আছে নেতাজীর পদচারণায় ধন্য বোলপুর শহর। বোলপুর আর শান্তিনিকেতন রয়েছে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবেই। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে সুভাষচন্দ্র শান্তিনিকেতনে এসেছেন ইলামবাজার হয়ে সড়ক পথে। শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্র বসুকে সম্বর্ধিত করেছেন ‘নেতাজী’ বলে। উত্তরায়ণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের একান্ত আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ সেই সময় সুভাষের চোখে যে ‘তরুণের স্বপ্ন’ দেখেছেন, তা কেউ কখনও প্রকাশ্যে আনেননি। যা আজও রহস্যাবৃত্ত থেকে গিয়েছে। বিশ্বজুড়ে যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের রণদামামা বাজছে তখন পরাধীন ভারতেও স্বাধীনতা আন্দোলনের মহাসমর শুরু হয়ে গিয়েছে। পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে সুভাষচন্দ্র তখনকার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। মহাত্মা গান্ধি এবং সুভাষচন্দ্রের মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্কে সেই সময় একটা ফাটলও তৈরী হয়। এই সময়ই ভারতীয় কংগ্রেস-হিংসা ও অহিংসা এই দুই ধারার আন্দোলনে খাদীপন্থী ও সুভাষপন্থী হয়ে উঠেছে। যা বিচলিত করে তোলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। আর সেই মুহূর্তে তিনি জওহারলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর মনোভাব পর্যালোচনার জন্য দু’ জনকেই আমন্ত্রণ জানান শান্তিনিকেতনে।জওহারলাল নেহরু গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসে তখন অবস্থান করছেন। পরে ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বেলা দেড়টা নাগাদ সুভাষচন্দ্র একটি মোটর গাড়িতে ইলামবাজার হয়ে সড়ক পথে বোলপুরের তখনকার লালমাটির পথে ধূলো উড়িয়ে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে এসে পৌঁছন। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও জওহারলাল নেহরু। সুভাষচন্দ্রকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-এস, এস সুভাষ এসো। আগে তুমি ভাল করে স্নান করে আহারাদি করে বিশ্রাম করো। তারপর কথা হবে। পরে বোলপুর শহরের কেন্দ্রভূমি কালীবারোয়ারীতলায় সম্বর্ধিত করা হয়েছিলো সুভাষচন্দ্রকে। তবে, সেই সময় বোলপুর এলাকায় গান্ধিবাদীদের প্রাধান্য থাকায়, সুভাষচন্দ্রের সম্বর্ধনা সভায় তেমন একটা লোক সমাগম হয়নি। আবার তিনি যখন বোলপুর চৌরাস্তায় এসে বসে থেকেছেন, তখনও সেখানে লোক সমাগম হয়নি। সেখানে হঠাৎ অনেক মানুষকে দেখে সুভাষচন্দ্র ভেবেছিলেন, তাঁকে দেখতেই বোধহয় লোক সমাগম হচ্ছে। পরে তিনি দেখেন, সেখানে এক মাদারি বাঁদর খেলা দেখাতে এসেছে। তাই দেখতেই মানুষের ভীড় হয়েছে, তাঁকে দেখতে নয়। সেদিন সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন-বোলপুরবাসী সাহায্য করুন আর না করুন, ভারতবর্ষ যদি স্বাধীন হয়, বোলপুরকে বাদ দিয়ে হবে না। পরে তিনি চলে গিয়েছিলেন শ্রীনিকেতনের পাশে বল্লভপুরের আমার কুটিরে। সেখানে তখন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের শিষ্য পান্নালাল দাশগুপ্ত চর্মশিল্প কেন্দ্রের আড়ালে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এখান থেকেই তখন আওয়াজ ওঠে- ফ্রি ডম ইজ মাই বার্থ রাইট। স্বাধীনতা আমার জন্মগত অধিকার। এখানে তখন তৈরী হয়েছে গোপন সূড়ঙ্গ পথ। এখানেই সুভাষচন্দ্র তাঁর পূর্ব পরিচিত পান্নালাল দাশগুপ্তের সঙ্গে গোপন বৈঠকও করেন। এক সময় ব্রিটিশ সরকার আমার কুটিরকে ‘ডেঞ্জারস প্লেস’ বলে অভিহিত করে আমার কুটিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই আমার কুটির থেকেই সশস্ত্র বিপ্লবীরা গিয়ে বোলপুর রেল স্টেশনের উপর দিয়ে যাওয়া ব্রিটিশদের খাদ্য ও অস্ত্র বহনকারী রেল আটকে দিয়ে ব্রিটিশ রাজ শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে নামেন। যাতে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায় বোলপুর কালীকাপুরের তারাপদ গুঁঁই ও জটা মাঝির। সেদিন তীর-ধনুক নিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন কয়েকশো সাঁওতাল যুবকও। তারপর বোলপুর এলাকায় সুভাষ অনুগামীর সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে, পরবর্তীতে স্বস্ত্রীক মহাত্মা গান্ধি বোলপুর রেল স্টেশনে নেমে আর শান্তিনিকেতনে যেতে পারছিলেন না সুভাষ অনুগামীদের বাধায়। এই খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ পুলিশের সাহায্য নিয়ে স্বস্ত্রীক মহাত্মা গান্ধির শান্তিনিকেতনে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই বোলপুর শহরেই সুভাষচন্দ্রের পূর্ব পরিচিত বীরভূমের লাভপুরের বাসিন্দা কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাতও হয়েছিলো। তাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী পালনকে ঘিরে বোলপুরে একটা উন্মাদনাও তৈরী হয়েছে।।
ছবি : কালীবারোয়ারীতলায় নেতাজী মূর্তি।
141 12,89,834