সব তীর্থের একটাই নাম: ‘বিরাটির হৃষিকেশ’
সুবল সাহা
পিন্টু মাইতি
একদিকে গুজব, আর একদিকে অপপ্রচার। এই দুই মিথ্যা স্তম্ভকে ভেঙে নতুন নির্মাণ করে চলেছেন উত্তর দমদমের একজন সমাজসেবী বিশ্বকর্মা। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জন্মলগ্ন থেকেই ভাইরাসের চক্রব্যূহে তিনি একাই অভিমুন্য। ভয়কে জয় করে আরও মানুষকে বরাভয় দিয়ে চলেছেন অনবরত।
করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে লকডাউনের কঠিন সময়ে বিরাটির অধিকাংশ সিনিয়র ও জুনিয়র চিকিৎসকেরা যখন বিভিন্ন কারণে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, সে সময় শক্ত হাতে হাল ধরে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন চিকিৎসক হৃষিকেশ মজুমদার।
বিরাটির স্বামী বিবেকানন্দ রোডে তাঁর চেম্বারে প্রতিদিনই লেগে রয়েছে অসুস্থ মানুষের ভিড়। ডাক্তারবাবুর কাছে রোগী আসবেন এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ঋষিকেশ মজুমদারের ব্যতিক্রম এটাই যে, তিনি এই কঠিন পরিস্থিতিতে একদিনের জন্য তাঁর চেম্বার বন্ধ করেননি এমনকি রাতবিরেতে টেলিফোন কল পেয়ে রোগীর বাড়িতে পর্যন্ত গেছেন। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে সাধারণ মৃত্যুতে যে সময় ডেথ সার্টিফিকেট লেখার মত চিকিৎসকও পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ভরসা ছিলেন একমাত্র ডাঃ মজুমদারই। এখনও যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে তেমন নয়। ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সামাজিক দায়বদ্ধতার কোন জায়গা থেকে তিনি পরিষেবা দিচ্ছেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, লকডাউনের প্রথম দিকে যখন করোনা সন্দেহে রোগীরা বিভিন্ন চেম্বারে যাতায়াত শুরু করেন, সে সময় বিশেষ করে সিনিয়র ডাক্তাররা কো-মরবিডিটির কারণে রোগী দেখা বন্ধ করে দেন, এটা ইচ্ছাকৃত তা বলা যাবে না। কিন্তু একজন জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই অভাব অনুভব করি। ডাক্তারি পড়েছি রোগীর চিকিৎসা করব বলে,তাহলে রোগকে ভয় পাবো কেন!
তিনি বলেন তাঁর কাছে অন্তত শতাধিক রোগী এসেছেন যাদের মধ্যে করোনার উপসর্গ ছিল, পরামর্শ মত টেস্ট করানোর পর অনেকের পজিটিভও ধরা পড়ে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের একাংশ হাসপাতালে স্থান পেলেও বহু রোগী কিন্তু এখনো হোম আইসোলেশনে থেকে নিয়ম মেনে চিকিৎসাধীন। সরকারি গাইড লাইন মেনে তিনি নিজেও নিয়মিত রোগীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ রেখে টেলিফোনের মাধ্যমে পরামর্শদান ও মনিটরিং করে চলেছেন। সে ক্ষেত্রে সুস্থতার সংখ্যাও কম নয়।
সম্প্রতি ডাঃ মজুমদার-এর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভুয়ো রটনা বাজারে চাউর হয়েছিল। কিন্তু যে চিকিৎসক দিনরাত এক করে করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসেন কিংবা তাঁদের চিকিৎসা পরিষেবা দেন, সেক্ষেত্রে তিনি ভাইরাস আক্রান্ত হতে পারেন। তাঁর মতে যাঁরা এটা প্রচার করেছেন তাদের বোঝা উচিত ছিল সমাজচেতনার সর্বাধিক স্তরে বিরাজ করা একজন চিকিৎসক কখনোই কোভিড আক্রান্ত হয়ে রোগীদের সামনে আসতে পারেন না। যদি এমনটাই হতো তিনি নিজে থেকেই চেম্বার বন্ধ করে দিয়ে সেলফ আইসোলেশনে চলে যেতেন।
লকডাউনে যখন ব্যতিক্রমী দু একজন ছাড়া অন্য চিকিৎসকের দরজা বন্ধ ছিলো অথচ এই কঠিন সময়ে রোগীদের পাশে থাকাটা যাঁদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, তখন একজন জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে কর্পোরেট লেভেলের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ডাঃ হৃষিকেশ মজুমদারের উদারতার পরিচয়কে কুর্নিশ জানিয়েছেন সমাজকর্মী সুখেন মজুমদার। তিনি বলেন, ডাক্তারবাবু এখনও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া বহু রোগীর কাছ থেকে স্বল্প ভিজিট নেন এমনকি বিনা ভিজিটেও চিকিৎসা প্রদান করে চলেছেন। চেম্বারে আসা সে সমস্ত রোগীর কাছে ডাঃ মজুমদার ইতিমধ্যেই “সেরা সমাজবন্ধু” হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেরই মন্তব্য, তীর্থ ভ্রমণ করতে গিয়ে যদি ভগবানের সান্নিধ্য পাওয়া যায়, তবে এই মুহূর্তে সব তীর্থের একটাই নাম- ‘বিরাটির হৃষিকেশ’।