রাম কা নাম বদনাম না করো…
অশোক মজুমদার
রাম নাম কাহে সব
ঠগ ঠাকুর জোয়া চোর
বিনা প্রেমকে রিঝত নাহি
তুলসী নন্দ কিশোরী
মনে পড়লো তুলসীদাসের রামায়ণের কথা। ৫০০ বছর আগে কথাগুলি তুলসীদাস বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন রাম নাম বা জয় শ্রীরাম ঢোল ঢাল পিটিয়ে মুখে বললেই হবেনা, বলতে হবে অন্তর থেকে।
বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন রাম মন্দিরের পিছনে সেই ভক্তি বা প্রেম আছে? নাকি এটা শুধুই ধর্মের সুড়সুড়ি ও রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা?
আরও অদ্ভুত মিডিয়ার ভূমিকা! লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর সময়ে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে শিলান্যাসের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন! করোনা নিয়ে ডক্টরেট করে ফেলা সঞ্চালকরাও বিজ্ঞানেরও তোয়াক্কা না করে মেতে উঠেছেন মন্দিরের শিলান্যাস নিয়ে!
মানুষের এই দুর্দশার দিনে মন্দিরের শিলান্যাস নিয়ে যারা হৈচৈ করছেন, রামও তাদের ক্ষমা করবেন না। ৫ই অগাস্ট আপনাদের কাছে হয়ে উঠবে এক অভিশাপের দিন।
পাড়ার একজন পজিটিভ হলে মানুষের কী দুর্দশা হয় আমরা তা প্রতিদিন দেখছি। স্বয়ং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ নিজেই আক্রান্ত। সেখানে লোককে আইন মানতে বলে আইন ভাঙছেন নিজেরাই। অতিমারির সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির মালিকের লাগামছাড়া ছাঁটাইয়ের কারণে কর্মহীন হচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ।
সেসময় স্টিলের কৌটোয় লাখ লাখ লাড্ডু বিলি করে উৎসবে মেতে উঠবেন মেকি রামভক্তরা। অতিমারির মৃত্যু মিছিল যখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ঠিক তখনই নিজেদের ঘোষিত সরকারি স্বাস্থ্যবিধির কোন তোয়াক্কা না করে তথাকথিত ‘রামভক্তরা’ রাম মন্দিরের শিলান্যাসের নামে শুরু করে দিয়েছে লোকদেখানো এক শো বিজনেস।
আমি মোটেই রাম মন্দিরের বিরুদ্ধে নয়।
আমাদের দেশে রাম ছিলেন,আছেন থাকবেন। এটা একটা বিশ্বাসের ব্যাপার। ভারতবর্ষে ধর্মাচারের স্বাধীনতা আছে।
কিন্তু বিজেপির ঝাণ্ডা তোলা ধর্ম ব্যবসায়ীরা রাম কে মানুষে মানুষে বিভেদ লাগানোর কাজে ব্যবহার করছেন। রাম মন্দির গড়ার নামে উস্কে দেওয়া হচ্ছে এই বিভেদকে। বহু মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। আমিও এই প্রতিবাদীদের দলে। কারণ, রাম-রহিমে বিভেদ লাগানোর রাজনীতিকে রুখতে না পারলে ভারত নামে দেশটির অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
অথচ কলাপাতা থেকে কসমিক রে, বিশ্বের সব ব্যাপার নিয়ে যিনি মন্তব্য করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিন্তু এই উন্মাদনা নিয়ে সম্পূর্ণ নীরব!
৫ই অগাস্ট রামমন্দিরের শিলান্যাস। জাঁকজমক দেখে অবশ্য দেশ তো বটেই এমনকি গোটা পৃথিবী যে গত ১০০ বছরেও না দেখা একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। যারা রামমন্দিরের নামে রাজনীতি করছেন তারা ভুলে গেছেন ভিতরে প্রেম না থাকলে মন্দির, রাম এসব কথা পরিহাসের মত শোনায়।
ভারতের সাধকরা যুগে যুগে কালে, কালে একই কথা বলে গেছেন। গৌতম বুদ্ধ, চৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দের মত মহাপুরুষেরা বাইরের আড়ম্বরের বদলে হৃদয়ের প্রেমভক্তি আর চিত্তের শুদ্ধির কথাই বলেছেন। মন্দির-মসজিদ-গির্জা সবই তো মানুষের জন্য। আর সেই মানুষই যখন একটা চরম দূরাবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তখন মন্দির গড়ার জন্য এই বিপুল আড়ম্বর মহামান্য কেন্দ্রীয় সরকার না করলেই পারতেন।
মানুষের কল্যাণে বহু যজ্ঞের কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু দেখেশুনে মনে হচ্ছে এখন ভক্তির থেকে রাজনীতি আর দেখনদারির জোরই বেশি। তাড়াহুড়ো করে এখনই একটা মন্দির গড়ে কী বার্তা দিতে চাওয়া হচ্ছে তা নিয়ে মানুষের প্রশ্ন আছে। আসল কথা হল ২০২১ এর ভোট, রামমন্দির গড়ে গোটা দেশে শাসকেরা নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক সংহত করতে চাইছেন। ভোটে জেতার জন্য, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিধি, মানুষের দুর্দশা, কোনকিছুরই তোয়াক্কা করা হচ্ছেনা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ অতিমারির বিপদ ডেকে এনেছে। ঠিক সেইসময় শাসকদলের প্রশ্রয়ে মন্দির গড়ার আড়ম্বরে লঙ্ঘিত হচ্ছে পরিবেশবিধিও। বিজ্ঞানকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে আপনাদের এই কাজের জবাব কিন্তু দেশের মানুষ দেবেই। দেশের প্রধানমন্ত্রীর এব্যাপারে সরব হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ব্যাপারস্যাপার দেখে মনে হচ্ছে এতে তার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে।
মন্দিরওয়ালাদের দাবি, এখানকার জাঁকজমক দেখে লোকের চোখ কপালে উঠবে। হীরা, পান্না, সোনা রুপো, তামা সব মিলিয়ে মন্দিরে পঞ্চরত্নের ছড়াছড়ি হবে। শুনলেই খারাপ লাগে। গরিব দেশে এই বিশাল আয়োজন দেখে মনে প্রশ্ন জাগে স্বয়ং রাম তাঁর রামরাজ্যে এমন কোন মন্দির তৈরির অনুমতি দিতেন?
একালের রামভক্তরা অবশ্য কোন অনুমতির ধার ধারেন না। তারা রামকে খুশি করতে মন্দিরে রাখবেন রুপোর নাগ-নাগিন, কচ্ছপ, ৪০ কেজি রুপোর ইট সহ নানা মহার্ঘ ধাতুর মূর্তি ও সামগ্রী, বাসন ইত্যাদি। তামার কলসিতে থাকবে সব রাজ্যের নদীর জল। প্রচার না থাকলে এত আড়ম্বর তো মাঠে মারা যাবে! তাই নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়্যারে দেখানো হবে রামমন্দিরের থ্রিডি শিলান্যাস। যাকে বলে গ্লোবাল পজিশনিং!
আমার প্রশ্ন, এই হাস্যকর শোঅফ কি মুছে দিতে পারবে মানুষের দুর্ভোগ, দুর্গতি ও মৃত্যুকে?
ধর্ম আর রাজনীতির এমন অদ্ভুত ককটেল সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই। এ তো রামের নাম করতে করতে তাঁকে বদনাম করা! হায় তুলসীদাস, রামকে আপনি এ কাদের হাতে ছেড়ে গেলেন!