নিরাপত্তার চাদরে যেন মোড়া হয়েছে শীতের কুয়াশা
দেহ ও মনের মিলনে স্খলন নেই জয়দেব-কেন্দুলির মেলায়
খায়রুল আনাম
তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাঁধা আছে কোন অদৃশ্য তারের টান ? তাকে ধরতে গেলেও দেয় না ধরা, এমনই মহিমা তার। কিন্তু পায়ে বাঁধা এক অদৃশ্য ঘুঙুর ঠিক বেজে ওঠে শেষ পৌষে। উচাটন মন ঠিক টেনে নিয়ে আসে জয়দেব-কেন্দুলির কোল ঘেঁষে বয়ে চলা শীতের শীর্ণকায় অজয় নদের তীরে। অচিন দেশ থেকে যেন ডাক দেয় তারকদাস বাউল। অজয়ের জলে পা ফেলে আর পা তুলে একতারার উদাসী সুরে মনের গহন-কালো অন্ধকার ঠেলে কতোটা পথ যে হাঁটি তা কী আমিই জানি ? চিকচিক বালুরাশির মাঝে ছিটকে পড়া রোদের আভায় এক উদাসী বাউল হলে কেন জানি না, শরীরের সব কামগন্ধ কেমন করে যেন উধাও হয়ে যায়। মন যখন বাঁধা পড়ে একতারার সূক্ষ্ম তারে তখন তোমার সাথে দেহে দেহে মিলন হলেও, স্খলন ও পতন তো হয় না। জয়দেব-পদ্মাবতীর চরণাশ্রিত হয়ে মন তখন খোঁজে সেই মনের মানুষকে। কোথায় আমার সেই আশানন্দন ? যাঁর পার্থিব শরীর এখানকার কদমখণ্ডির ঘাটে চিতার ধোঁয়ার কুণ্ডলিতে বিলীন হয়ে গেলেও, এখনও শুনি তাঁর সেই উদাসী ডাক-দেশ-বিদেশের মানুষ গো যাও এই বীরভূম ঘুরে। এখানে এখনও ইচ্ছে করে তমাল-বটের ছায়ায় কিছুটা জিরিয়ে নিতে। এখানেই কী পাতা আছে আমার শেষ শয্যা ? জিজ্ঞাসিছে কী কোনও ভোরের ভৈরবী ? আশ্রমের ধোঁয়া ওঠা কাঠের অঙ্গার কী ধীক ধীক জ্বলে মনের মানুষ-বিহনে। চলো, আরও একবার বা বহুবার জয়দেব-কেন্দুলির শীতের অজয়ে পা ফেলে পা তুলে হেঁটে যায় অচিনপুরের দিকে। একতারা আর গুবগুবির সাথে পায়ের ঘুঙুরের শব্দে খুঁজেফিরি সেই মনের মানুষটারে।
সময় আর আমাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে না বীরভূমের ইলামবাজার ব্লকের বীরভূম জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হওয়া জয়দেব-কেন্দুলির মেলার সেই পুরনো রূপটা। শ’পাঁচেক দোকান আর শ’ তিনেক আখড়ায় এখন কী আর সেই প্রাণের টান রয়েছে ? সিদ্ধ বটমূলের নীচে কাঠের আগুনের কুণ্ডলির পাশে বসা সাধু-সন্তদের অনেকেই কিন্তু আজও নিশ্চল রয়ে গিয়েছেন তাঁদের ত্যাগ ও সাধনায় অবিচল থেকে। কীর্তনের একবগ্গা কী ঢেকে দিচ্ছে বাউলের একতারা আর গুবগুবির সুরকে ? প্রশ্নটা উঠছে বার বার। বাংলা তথা দেশের অন্যতম জয়দেব-কেন্দুলির মকরসংক্রান্তির বাউল মেলার কী আমূল বদল ঘটে যাচ্ছে অন্তর-বাহিরে ? রবিবার ১৪ জানুয়ারি বিকালে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঁচ দিনের জয়দেব-কেন্দুলির মেলার সানুষ্ঠান উদ্বোধন করলেন রাজ্যের ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ দফতরের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। উপস্থিত ছিলেন রাজ্য বিধাসভার ডেপুটি স্পিকার ড. আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলাশাসক বিধান রায়, জেলা পরিষদের সভাধিপতি শেখ ফায়েজুল হক কাজল, বোলপুরের মহকুমাশাসক অয়ন নাথ, বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী, বিধান মাঝি প্রমুখ। ঐতিহ্যবাহী জয়দেব-কেন্দুলির মেলাতে আসা পুণ্যার্থীদের জন্য সমস্ত ধরনের সুবিধা ও নিরাপত্তা দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। রাধাবিনোদ মন্দিরে পুজো দিতে পুণ্যার্থীদের পুজো দিতে যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ওড়ানো হচ্ছে ড্রোন ক্যামেরা। রয়েছে একশোটির বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা। পুলিশের প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে গোটা মেলা জুড়ে। মেলার প্রবেশ পথের আগেই যানবাহনগুলি রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তৈরী হয়েছে ড্রপগেট। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে চিকিৎসা পরিষেবার সমস্ত ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পানীয় জলের যাতে কোনও সমস্যা না হয় সে জন্য পাইপলাইনের মাধ্যমে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।তৈরী করা হয়েছে দু’শোটি অস্থায়ী শৌচাগার। দমকল বিভাগ এবং বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে হাজির রয়েছেন মেলায়।
এদিন লক্ষ্মণদাস বাউলের বাউল গানের মধ্যে দিয়ে মুখরিত হয় জয়দেব-কেন্দুলি মেলার উদ্বোধনী মঞ্চ। মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ জয়দেব-মেলায় আগত সকলকে স্বাগত জানানোর সাথে সাথে মেলার সার্বিক সাফল্য কামনা করেন। ড. আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বক্তৃতায় জয়দেব-পদ্মাবতীর জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার সাথে সাথে জয়দেব মেলার ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করেন।
ছবি : জয়দেব-কেন্দুলি মেলার উদ্বোধন।