Spread the love

যশোরে সাড়া ফেলেছে ‘আমার আদালত’
মুঠোফোনে অ্যাপ থেকে জানা যাবে
বিচারিক সব তথ্য

নিজস্ব সংবাদদাতা।। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার তাহেরপুর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আব্দুর রহিম (৮২)। যশোরের আদালত চত্ত্বরে তার যাতায়াত চলছে অন্তত ২০ বছর। ২০০০ সালের প্রথম দিকে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে মামলা করেন তিনি। সেই থেকে প্রতি মাসে একবার করে আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। লেখাপড়া না জানা আব্দুর রহিম জানেন না তার মামলার কি গতি প্রকৃতি। আইনজীবী সহকারী তাকে দিনের পর দিন মামলার হাজিরা দিতে বাধ্য করছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসে বৃদ্ধ আব্দুর রহিমের সাথে তার আইনজীবীর হঠাৎ দেখা। এক পর্যায়ে আব্দুর রহিম আইনজীবীকে মামলা চালাতে অপরাগতা প্রকাশ করে প্রকাশ্যে জনতার মধ্যে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। আইনজীবী তাকে চেম্বারে দেখা করতে বলেন। পরে তার চেম্বারে গেলে মামলার ফাইলপত্র চেক করে ওই আইনজীবী দেখেন প্রায় ১০ বছর আগে তার মামলা খারিজ হয়ে গেছে। তারপরও আইনজীবী সহকারী তার কাছ থেকে ১০ বছর ধরে প্রতি মাসে মামলার হাজিরার তারিখ দেখিয়ে টাকা নিয়েছেন। চরম অনৈতিকতার এ বিষয়টি চাউর হলে ওই আইনজীবী সহকারীকে আদালত পাড়ায় ঢুকতে নিষেধ করা হয়েছে।
বর্তমানে যশোর আদালত চত্ত্বরের দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়েছে। মামলার পরবর্তী তারিখ ও পদক্ষেপ জানতে এখন আর কারও কাছে ধর্ণা দিতে হচ্ছে না। নিজের মুঠোফোনে ‘আমার আদালত’ অ্যাপ থেকেই জানা যাচ্ছে সব তথ্য।
আগে মামলার যেকোন তথ্য জানতে হলে আদালতের এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরতে হতো। কখনো আইনজীবী আবার কখনো আইনজীবী সহকারীদের কাছে ভরসা করতে হতো। এতে সময়ের পাশাপাশি অপচয় হতো অর্থের। গত ২ আগস্ট থেকে যশোরের বিচার ব্যবস্থায় চালু হওয়া এই মুঠোফোন ইতোমধ্যে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

‘আমার আদালত’ অ্যাপ চালুর পর ঘরে বসে মুহূর্তে জানা যাচ্ছে মামলার সর্বশেষ তথ্য। এতে করে বিচারপ্রার্থীরা সুফল পাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের সেবা চালু হওয়ায় বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী থেকে শুরু করে আদালত সংশ্লিষ্ট সকলেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। জেলা জজ আদালতের আইনজীবীরা বলছেন, অনলাইনে এমন সেবা চালু হওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমেছে। অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাচ্ছে মামলার সর্বশেষ অবস্থা।
সূত্র জানিয়েছে, যশোরের ৩৬ আদালতের সব মামলার তথ্য এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য ব্যবহার করতে হচ্ছে ‘আমার আদালত’ অ্যাপ। প্রথমে সংশ্লিষ্ট বিভাগ, পরে জেলা এবং সবশেষ সংশ্লিষ্ট আদালতের নাম নির্বাচন করে বিচারপ্রার্থীরা তাদের মামলার সবশেষ আদেশ, পরবর্তী তারিখ এবং মামলার অবস্থা জানতে পারছেন। গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘আমার আদালত’ (মাইকোর্ট) সার্চ করে যে কেউ এই অ্যাপ ডাউনলোড করতে পারছেন।
গত ১৩ আগস্ট মণিরামপুর উপজেলার মিল্টন নামে এক ব্যক্তির মামলার শুনানি হয়। আইনজীবীর ব্যস্ততার কারণে মামলার পরবর্তী তারিখ জেনে যেতে পারেননি তিনি। পরে নিজের মুঠোফোন থেকে ‘আমার আদালত’ অ্যাপের মাধ্যমে মামলার বর্তমান অবস্থা ও পরবর্তী শুনানির তারিখ জেনে নিয়েছেন মিল্টন।
এ বিষয়ে মিল্টন বলেন, ‘আগে মামলার তথ্য জানতে অনেক কষ্ট করতে হতো। পেশকার এবং আইনজীবী কাছে ধর্ণা দিতে হতো। অনেক সময় তাদের পাওয়া যেতো না। এখন নিজের মুঠোফোন থেকে সব তথ্য জেনে নিচ্ছি। এতে অনেক সুবিধা হয়েছে।’
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল- ১ এর পিপি অ্যাড. সেতারা খাতুন বলেন, ‘সরকারের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। অনেক সময় ব্যস্ততার কারণে মক্কেলদের মামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে সময় লাগতো। এতে ভোগান্তিতে পড়তেন বিচারপ্রার্থীরা। এখন অনলাইন সেবায় বিচারপ্রার্থী নিজেই নিজের মামলার সব তথ্য জেনে নিতে পারছেন। এতে আমাদের চাপ অনেকটা কমে গেছে। সেইসাথে সুফল পাচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা।’
এটিকে যুগোপযোগী দাবি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল- ২ এর পিপি অ্যাড. মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল বলেন, ‘সময় নেই অসময় নেই মক্কেলরা তাকে কল করতেন। জানতে চাইতেন মামলা সম্পর্কে। খুঁজতে হতো ডায়েরি অথবা কল করতে হতো সহকারীকে। কিন্তু এখন আর তা করা লাগছে না। মুঠোফোনে ‘আমার আদালত’ অ্যাপে প্রবেশ করে সব তথ্যই জানা যাচ্ছে। ফলে আর বেগ পেতে হচ্ছে না আমাদের।’
অ্যাপে আইনি সেবা চালু হওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমেছে বলে জানান জেলা জজ আদালতের পিপি অ্যাড. এম ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, ‘সরকার সব ক্ষেত্রে সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। ‘আমার আদালত’ অ্যাপের মাধ্যমে আইনি সেবা তার একটি বাস্তব উদাহরণ। এটি দেশের বিচার অঙ্গনে একটি মাইলফলক। বিচারপ্রার্থীর বিড়ম্বনা কয়েক গুণ হ্রাস পাবে।’ তবে তিনি বলেন, ‘এই অ্যাপের বিষয়ে এখনো অনেক বিচারপ্রার্থী জানেন না। আরও বেশি প্রচারণা প্রয়োজন।’
মামলা সংশ্লিষ্টরা যতবেশি এ বিষয়ে জানতে পারবেন এবং ব্যবহার করতে পারবেন তত বেশি সুফল আসবে বলেও মন্তব্য করেন পিপি এম ইদ্রিস আলী।
যা রয়েছে ‘আমার আদালত’ অ্যাপে অনলাইন কজলিস্ট (মামলার কার্যতালিকা), জুডিসিয়াল মনিটরিং ড্যাশবোর্ড এবং ‘আমার আদালত’ (মাইকোর্ট) মুঠোফোন অ্যাপ চালু করা হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট কার্যদিবসে আদালতে বিচারাধীন মামলার তালিকা জনগণ কিংবা বিচার সংশ্লিষ্ট যে কেউ ‘আমার আদালত’ (মাইকোর্ট) অ্যাপ ভিজিট করে তার মামলার সর্বশেষ তথ্যাদি পাবেন।
এই অ্যাপে অধস্তন আদালতসমূহের বিচারাধীন এবং নিষ্পত্তি হওয়া মামলা সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে। এর মাধ্যমে মামলার প্রকৃত অবস্থা, কার্যক্রমের গতি প্রকৃতি এবং বিচারিক নানা পরিসংখ্যান জানা যাবে।
বিচারপ্রার্থীসহ সর্বস্তরের জনগণ, বিচারক আইনজীবীরা নিজ নিজ প্রয়োজনে ‘আমার আদালত’ (মাইকোর্ট) মুঠোফোন অ্যাপটি ব্যবহার করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *