ভারতে ব্যাঙ্কিং, বিত্তীয় পরিষেবা এবং বীমা ক্ষেত্রের কোম্পানিগুলোর রেকর্ড মুনাফা বৃদ্ধি:
পার্থপ্রতিম সেন (প্রাক্তন চেয়ারম্যান পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাংক)
ভারতে কোভিডের সময় অন্যান্য ক্ষেত্রের কোম্পানিগুলোর কাজকর্ম বন্ধ বা কমে গেলেও ব্যাঙ্কিং, বীমা ও অন্যান্য বিত্তীয় পরিষেবা প্রদানের কোম্পানিগুলোর কর্মীরা দিনরাত কাজ করে দেশের অর্থনীতি সচল রেখেছিলেন।
তাই দেখা যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে ২০২০ সাল থেকে নন-ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর তুলনায় ব্যাঙ্কসহ ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর আয় ও মুনাফা বেড়ে যাচ্ছে।
চলতি বছরে ব্যাঙ্কগুলির মুনাফা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিম্নোক্ত কারণগুলি: ব্যাঙ্কের ঋণের ব্যবসা অনেক বেশি বৃদ্ধি, আমানতের তুলনায় প্রদেয় ঋণের উপর সুদের হার বেশি বৃদ্ধি, এনপিএ বা অনুৎপাদক সম্পদ কমে যাওয়া।
তবে অতি সম্প্রতি ব্যাঙ্কগুলি আমানতের উপর সুদের হার বাড়ানোয় ব্যাঙ্কের আমানত বৃদ্ধির হার ব্যাঙ্কের ঋণ ব্যবসা বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে।
চলতি বিত্তীয় বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২২) দেশের সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রের ফিনান্সিয়াল ও নন-ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর যা মোট মুনাফা হয়েছে, তার ৪১.৫ শতাংশই করেছে ব্যাঙ্কিং, বিত্তীয় পরিষেবা এবং বীমা ক্ষেত্রের কোম্পানিগুলো।
তবে ২০২০ সালের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে এই অনুপাত ছিল ৬০ শতাংশ কারণ সেইসময় কোভিডের জন্য লকডাউনের কারণে নন-ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর অনেকের মুনাফা অনেকটা তলানিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং অনেক কোম্পানি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তখন ক্ষুদ্র,ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলোর ব্যাঙ্কঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সময় যেমন বাড়িয়েছিল তেমনি নির্ধারিত কমসুদে নতুন ব্যাঙ্কঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছিল।
ব্যাঙ্কিং ও ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কের শেয়ারের বিশেষতঃ বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর শেয়ারের দাম অনেক বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে ব্যাঙ্কে আমানত রেখে বছরে যত সুদ পাওয়া যায়, তার থেকে ব্যাঙ্কের শেয়ারে লগ্নি করলে বছরে রিটার্ণ বেশি আসছে সাম্প্রতিক কালে। তবে শেয়ার বাজারে ঝুঁকি আছে, শেয়ারের দামে নিত্য উঠানামা আছে। তাই বুঝেশুনে অগ্ৰসর হওয়া ভালো।
পাশাপাশি দেখা যায় যে নন-ফিনান্স কোম্পানিগুলোর চলতি আর্থিক বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে নিট মুনাফা গত আর্থিক বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তুলনায় ২০ শতাংশ কমে গেছে।
তবে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর, ২০২২) দেখা যাচ্ছে, কোভিড পরবর্তী অর্থনীতিতে চাহিদা ও উৎপাদন বাড়ার ফলে নন-ফিনান্সিয়াল কর্পোরেটদের ব্যাঙ্ক থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েছে এবং ব্যাঙ্কের ঋণের উপর সুদের হার বাড়ানোর ফলে অনেক বেশি পরিমাণ সুদ ব্যাঙ্ককে পেমেন্ট করতে হচ্ছে যা কিছুটা হলেও কোম্পানির মুনাফায় আঘাত করছে।
তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার জন্য ভারত থেকে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি অনেক কমে গেছে। তার ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর কাঁচামাল ও তৈরি পণ্যের স্টক বা ইনভেন্টরি বেড়ে গেছে যেখানে কোম্পানিগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ফান্ড আটকে আছে যার জন্য কোম্পানিগুলোকে ব্যাঙ্ক ঋণের উপর সুদ দিতে হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে মন্দা দেখা দিলে তার প্রভাব দেশের বাজারেও কিছুটা পড়ে। সবমিলিয়ে ভারতে নন-ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর অবস্থা এই মূহুর্তে খুব সুখকর মনে হচ্ছেনা, কোম্পানিগুলোর ব্যালেন্স শিট দুর্বল হচ্ছে।এইভাবে চললে আগামীদিনে কোম্পানিগুলো ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুনভাবে লগ্নি করবে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ অবশ্যই আছে।
আর নন-ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর স্বাস্থ্য ভালো থাকতে পারেনা।
দেখা যাচ্ছে নন-ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর ইন্টারেস্ট কভারেজ রেশিও কমে যাচ্ছে, সেটা ব্যাঙ্কের জন্য অশনি সংকেত, কারণ কোম্পানির আইসিআর বা ইন্টারেস্ট কভারেজ রেশিও যত কমবে, কোম্পানির সুদ পরিশোধের ক্ষমতা তত কমবে। একটি কোম্পানির আইসিআর হল সেই কোম্পানির ঋণের উপর দেয় সুদের তুলনায় অপারেটিং মুনাফা কতগুণ, সেটা বোঝায়।
তাছাড়া ক্রমাগত যদি নন-ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর স্বাস্থ্য ভালো থাকেনা অর্থাৎ সেলস্, মুনাফার যদি বৃদ্ধি না হয়, তাহলে ব্যাঙ্ক থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি দিতেও কোম্পানিগুলো অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারে, সেই ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের এনপিএ বা অনুৎপাদক সম্পদ বাড়তে পারে যা ধীরে ধীরে ব্যাঙ্কের ব্যালেন্স শিটকেও দুর্বল করতে পারে।
একেই বলে ” টুইন ব্যালেন্স শিট সিন্ড্রোম” বা ” দু’টো ব্যালেন্স শিট- এর সমস্যা”
( ব্যাঙ্কের ব্যালেন্স শিট এবং ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেয়া কোম্পানির ব্যালেন্স শিট)
অর্থাৎ পণ্য উৎপাদন এবং অবিত্তীয় পরিষেবা জড়িত অর্থনীতিতে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ও জোগানের সমস্যা, মূল্যস্ফীতি, দক্ষ শ্রমিকের অভাব ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে যদি নন-ফিনান্স কোম্পানিগুলোর পারফর্ম্যান্স নিম্নগামী হয় এবং তার ফলে অর্থনীতিতে উৎপাদন ও আয়ের গতি শ্লথ হয়ে যায়, সেই রকম পরিস্থিতিতে ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর
পারফর্ম্যান্সও অদূর ভবিষ্যতে নিম্নগামী হবে কারণ ফিনান্সিয়াল এবং নন-ফিনান্সিয়াল কোম্পানিগুলো একে অন্যের পরিপূরক বা বলা যায় ওদের পারস্পরিক ভাগ্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
তাছাড়া আজ গ্লোবাল ইকনমির যুগে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং অর্থনীতির গতি প্রকৃতির উপর ভারতের অর্থনীতি অনেকাংশেই নির্ভরশীল।
তবে ১৪০ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ এক বিশাল বাজার।
তাই ভারতের সাধারণ জনগণের যদি গড় আয় বাড়ানো যায়, তাহলে ভারতকে উন্নত দেশগুলির আর্থিক সমৃদ্ধি বা প্রগতির উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হবেনা বা উল্টোভাবে বললে বলা যায় উন্নত দেশগুলিতে অর্থনৈতিক মন্দা আসলেও ভারতে জিডিপি খুব উচ্চতায় না পৌঁছালেও মন্দার আওতায় আসবেনা, সেটা হলফ করে বলা যায়।