আজ কি গ্রেপ্তারের মুখে নানুরের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ কেরীম খান ?
মোল্লা জসিমউদ্দিন,
আজ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দুপুরে কলকাতার সিবিআইয়ের অফিস নিজাম প্যালেসে গরু পাচার মামলায় তলব করা হয়েছে বীরভূম জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ কেরীম খান কে।এর আগে তাঁর বাড়িতে গরু পাচার মামলায় দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এবং ইডি যৌথ অভিযান চালিয়েছে। এর পাশাপাশি বোলপুরের রতনকুঠিতে, দুর্গাপুরে এবং নিজাম প্যালেসে জেরা চালিয়েছে সিবিআই। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে – আজ গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হতে পারেন এই নেতা।যিনি জেলবন্দি অনুব্রত মন্ডল এর অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন।তবে গ্রেপ্তার হবেন কিনা সেটা সিবিআইয়ের উপর নির্ভর করছে।তবে যেভাবে ধাপে ধাপে ব্যাঙ্কিং লেনদেন, বিপুল সম্পত্তির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছে সিবিআই – ইডি,সেখানে গ্রেপ্তারির সম্ভাবনা প্রবল বলে আইনজীবীদের একাংশের ধারণা। যেভাবে পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল সিবিআই এজলাস গরু পাচার মামলায় তদন্তের সময়সীমা নিয়ে সিবিআইয়ের কাছে কৈফিয়ত তলব করেছিল।তাতে সিবিআইও চাপে এই তদন্তের গতি ক্রমশ বাড়াতে।
গরু পাচার মামলায় যেভাবে একযোগে দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই – ইডি দুরন্ত গতিতে তদন্ত চালাচ্ছে, তাতে বিচলিত অনেকেই।পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট হলো জেলবন্দি বীরভূমের দাপুটে তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডল এর খাসতালুক। একদা এই মঙ্গলকোটের রাজনৈতিক রাশ ঘিরে অনুব্রত মন্ডল রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীকেও জব্দ করিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, এমনকি একদা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী অনুগামীদের বিরুদ্ধে কুড়ির বেশি মাদক মামলা দাখিল হয়েছিল। গত ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মঙ্গলকোট হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক হানাহানিতে উত্তপ্ত। রাজনৈতিক মহলে দাবি, – মঙ্গলকোট পূর্ব বর্ধমান জেলার সাংগঠনিক ভাবে সম্প্রতি যুক্ত হলেও এখানকার নেতাদের ‘হৃদয়’ বোলপুর কেন্দ্রিক।অনেক ‘মধু’র ইতিহাস আছে নাকি এখানে ? গরু পাচার কান্ডে অনুব্রতের বেনামি সম্পত্তির ভুগোলের সন্ধান দিতে পারে এই মঙ্গলকোট-ই বলে অনেকেরই দাবি।পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের কৈচর গরুর হাটের সাথে বীরভূমের ইলামবাজার গরুর হাটের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে। কেতুগ্রাম সংলগ্ন ফুটিসাঁকো এলাকায় রাইস মিল ঘিরে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। মঙ্গলকোট সীমান্তবর্তী বীরভূমের নানুরে রয়েছেন বীরভূম জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ কেরিম খান।যাঁকে সিবিআই বেশ কয়েকবার ডেকেছিল এবং কেরিম বাবুর বাড়ি সহ ঘনিষ্ঠদের বাড়িতেও অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েক টি মোবাইল বাজেয়াপ্ত করেছে সিবিআই – ইডি গত ৩ আগস্ট । অজয় নদের বালিঘাটে নানুর – মঙ্গলকোটে একছত্র আধিপত্য এই কেরিম খানের নাকি! যদিও কেরিম বাবু বরাবরই তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ অস্বীকার করে থাকেন।মঙ্গলকোটের লোচনদাস সেতু সংলগ্ন এক বালিঘাট ব্যবসায়ীর লটারি দোকানের মাধ্যমে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কালো টাকা সাদা করা হয় বলে বিশেষ সুত্রে জানা গেছে। আসলে এখানে শাসক দলের নেতারা প্রায় লটারির ‘টপ প্রাইজে’র অর্থ কপাল গুনে পেয়ে যান নাকি? মঙ্গলকোটের নুতনহাট বাইপাস এলাকার এক পুকুরের পাড়ে বিপুল ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে? এইসব কারা করছে? এগুলি সিবিআই – ইডির গুরত্বপূর্ণ ভাবে দেখা উচিত বলে বিরোধী রাজনৈতিক গুলির দাবি। এর আগে বীরভূমের নানুরে সিবিআই হানা চলেছে, তাতে তটস্থ পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট।অজয় নদের এপারে বীরভূমের নানুর,অজয় নদীর ওপারে পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট রয়েছে । সীমান্তবর্তী নানুর – মঙ্গলকোট দুটি এলাকায় রাজ্য রাজনীতিতে ঘুরে ফিরে আসে বারবার, খুন রাহাজানি বিশেষ করে অজয় নদের দেদার বালিলুট নিয়ে।ঠিক সেইরকমই সম্প্রতি নানুরের বাসাপাড়া এলাকায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ও ইডির আচমকা বড়সড় অভিযান চলেছিল।বীরভূম জেলা পরিষদের প্রভাবশালী পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ এর বাড়িতে।যদিও তিনি বাড়িতে ছিলেন না সেসময় । পাশাপাশি এই কর্মাধ্যক্ষ এর বকলমে এক হিসাব রক্ষকের বাড়িতেও চলেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের অভিযান।বেশকিছু মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। গরু পাচার মামলায় বীরভূমের দাপুটে নেতা অনুব্রত মন্ডল ‘ঘনিষ্ঠ’ ধৃত সায়গল হোসেনের বিপুল সম্পত্তির খোঁজে, ভোট পরবর্তী হিংসা মামলার তদন্তে এসেছিল।তবে নানুরের এই সিবিআই ইডির অভিযানে তটস্থ সীমান্তবর্তী পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট এলাকা। নানুরের সীমান্তবর্তী এই মঙ্গলকোটের নুতনহাট এলাকায় এক জমি দালাল রয়েছেন।যিনি মঙ্গলকোট, নানুর, বোলপুর, পাথরচাপরি এলাকায় বিভিন্ন জমি কেনাবেচার দলিল করেছেন ‘পাওয়ার অফ এটনি’ দেখিয়ে।জমি /জায়গা কেনবার সময় আর্থিক লেনদেনের উল্লেখ নেই দলিলগুলিতে ।তবে ওই দালাল সম্পর্কিত জমি/জায়গা বিক্রি করার সময় দলিলে অর্থের লেনদেন রেখেছে।কেনবার সময় নেই কেন! এটাই বড় রহস্যের।এটি একপ্রকার ব্লাক মানি কে হোয়াইট মানি করার কৌশল। ওই জমি দালালের শতাধিক দলিলে এইসব কর্মকাণ্ড রয়েছে। এইসব এলাকায় ( পূর্ব বর্ধমান ও বীরভূম) সাব রেজিস্ট্রার অফিসে বিশেষ করে মঙ্গলকোটের নুতনহাট সাব রেজিস্ট্রার অফিসে গত দশ বছরের দলিল খোঁজা হলে অনেক তথ্য কেন্দ্রীয় আর্থিক বিষয়ক তদন্তকারী সংস্থা ইডি পেতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। পাশাপাশি মঙ্গলকোটের নুতনহাট এলাকায় ওই জমি দালালের প্যান কাডে রিপোর্ট নিলে ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্য এক দিগন্ত খুলে দিতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।এমনকি বিদেশ থেকে অর্থ লেনদেনে হাওলা যোগও পেতে পারে!এমনকি এই জমি দালাল সুদের কারবারে সিদ্ধহস্ত। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের একাংশ আধিকারিকদের সাথে দহরম মহরম দেখা যায়। বিভিন্ন দলীয় অফিসে জমি জায়গা বিষয়ক সালিশি সভায় তার এক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।সম্প্রতি বীরভূমের নানুরে সিবিআই ও ইডির অভিযানে অভিযুক্তদের সাথে এই জমি দালালের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে বলে জনশ্রুতি । অনেক জায়গায় নামে – বেনামে নেতাদের সম্পত্তি গড়তে এই জমি দালালের সিন্ডিকেট কে ঠিকমতো চিহ্নিতকরণ করতে পারলে সিবিআই বিশেষ করে ইডির তদন্ত অনেক সহজ হয়ে যাবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।তবে সবটাই তদন্ত সাপেক্ষ। অভিযুক্ত ওই জমি দালাল বরাবরই এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে গেছেন। সাম্প্রতিক সময়কালে গরু পাচার কান্ডে পুলিশের এক কনস্টেবল সায়গলের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দেখে বাকরুদ্ধ হয়েছে অনেকেই। মহানগরে দামি দামি ফ্ল্যাট, অজশ্র জমি জায়গার দলিল, ৭০ কেজি সোনা,ইত্যাদি ইত্যাদি !তাহলে গরু পাচারের মুক্তাঞ্চল থানা, মহকুমা, জেলার আধিকারিকদের একাংশের খোঁজখবর নিলে আরও অজানা তথ্য প্রকাশ পাবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। অনেকেরই দাবি- ‘কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ও ইডি এইসব এলাকায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের একাংশের দায়িত্বভারের ইতিহাসে নজরদারি চালালে বিপুল সম্পত্তির ভূগোলের সন্ধান পেতে পারেন’। মূলত বীরভূম – পূর্ব বর্ধমান – মুর্শিদাবাদ – নদীয়া জেলা গুলিতে বেশ কয়েকজন অফিসার এমন আছেন, যাঁরা ২০১৪ থেকে এইসব এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। এইসব পুলিশ অফিসারদের থানায় গাঁজা পাচারের মামলা বেশি হয়েছে বলে দাবি বিভিন্ন সুত্রে।শুধু গরু পাচার নয়, বালি পাচারে শীর্ষে এইসব এলাকাগুলি। অজয় – ভাগীরথী (গঙ্গা) নদীর উপকূলে এইসব এলাকা।এঁদের মধ্যে কেউ কেউ কয়লা পাচার কান্ডে ইডির তলবও পেয়েছেন।এখন দেখার গরু পাচার মামলায় সিবিআই এবং ইডি বীরভূমের নানুর ও পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে কোন যোগসূত্র খুঁজে পায় কিনা?