এখন আমাদের অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি দুয়ো রাণীর মতো অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে
আমাদের হরিশংকর পুর অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুলের মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ এখনও নাকে লাগে যখন ওই স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই । এখন তার গায়ে মাটির গন্ধ নেই । ঝাঁ চকচকে দু’তলা বাড়ি । আমাদের বেলায় ছিল মাটির দেয়াল, ভাঙ্গা কাঠের জানালা । এক রুম থেকে অন্য ক্লাস রুমে যাবার জন্যে ভিতরে মাটির পার্টিশন দেয়াল ছিল । ওই দেয়ালের ভিতর দিয়ে এক রুম থেকে অন্য রুমে আমরা ছোটাছুটি করতাম । মাটি মাটি গন্ধ আমার খুব ভালো লাগত । এখনও তার সেই গন্ধ পাই ।
প্রথম দিনের কথা মনে আছে । খুব কেঁদে কেঁদে স্কুলে গিয়েছিলাম শচীন ,বাপি, কালির সঙ্গে । স্কুলে যাবার পর আমার ভয় কেটে গেল । ইনফ্যান্টে ভর্তি হতে লাগত না । আমার বগলে ছিল একটা বসার আসন, স্লেট ,আর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বর্ণ পরিচয় ‘। মা আমাকে বসার জন্যে বস্তা দিয়ে ছিলেন । প্রথম দিনে দিদিমণি আমার বস্তা পেতে দিয়েছিলেন অন্যদের সাথে মেঝেতে । অ,আ ই,ঈ পড়িয়ে ছিলেন । বইতে টিক মেরে দিলেন পরের দিনের পড়া মুখস্ত করার জন্যে । আমি মাথা নেড়েছিলাম । একদিন তিনি আম,জাম বানান লিখতে দিলেন । কালি আমার স্লেটে জাম বানান লিখে দিল আমি লিখতে পারছিলাম না । দিদিমণিকে দেখালাম । তিনি চক পেনসিল দিয়ে আমার স্লেটে ঠিক চিহ্ন দিলেন । আমার খুব আনন্দ
হয়েছিল । তিনি আমাদেরকে খুব ভালোবাসতেন । তাঁর কাছে পড়তে আমার খুব ভালোলাগত ।
ক্লাস টু-তে উঠলাম । আলমারির মাথার উপরে একটা গনণা যন্ত্র (আ্যবাকাস) দেখতাম । হাত দিয়ে ধরতে খুব ইচ্ছা হতো । তখন একে চন্দ্র ,দুয়ে পক্ষ শিখে ফেলেছিলাম ।
ধাপে ধাপে ক্লাস ফোরে উঠলাম । হেডস্যার শুধু আমাদের ক্লাসে পড়াতেন । কারণ সামনে বছরে আমরা বৃত্তি পরীক্ষা দেব । কিন্তু আমরা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারিনি । আমাদের সময় থেকে ওই পরীক্ষা উঠে যায় । আমার খুব দুঃখ হয়েছিল । বৃত্তি পরীক্ষার দিন সকালে দেখতাম ছাত্র ,ছাত্রীরা বাবা ,মা র হাত ধরে আমাদের পাশের গ্ৰামের কড়ামনুরাজ হাই স্কুলে পরীক্ষা দিতে আসত । দলে দলে তাদেরকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখতাম । বেশ ভালো লাগত । আশেপাশে কতকগুলো স্কুলের বৃত্তি পরীক্ষার সিট পড়ত ওই হাই স্কুলে । তখন পরীক্ষা মানে আনন্দ ছিল । পরীক্ষার দিন সকাল সকাল সাবান টাবান মেখে, ভালো জামা, প্যান্ট পরে পরীক্ষা দিতে যেতাম ।
আমাদের হেডস্যার কড়া ছিলেন । প্রথম দিনে তিনি আমাকে ভালো করে পড়ার কথা বলেছিলেন। আমি কাঁচা ছিলাম । ভলো করে না পড়লে আমাকে আবার ক্লাস থ্রীতে নামানো হতে পারে শুনে আমার ভালো লেগেছিল । কাঁচা পাকা মানে অর্থহীন ছিল আমাকে দেখে স্যার মনে হয় বুঝতে পেরেছিলেন । তাই তিনি হেসে ফেলেছিলেন । আসলে স্কুল ছাড়ার কথা শুনে আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল ।
একদিন হেড স্যার ক্লাসে সরকারি বইগুলো আমাদেরকে দিলেন । আমার অঙ্কের বইটা পুরাতন আর একটু ছেঁড়া । সবার নতুন আমার কেন ছেঁড়া আমার খুব মন খারাপ হল । টিফিনের সময় দীপকের থেকে আমার ছেঁড়া
বই চেঞ্জ করলাম । তার নতুন অঙ্কের বইটা নিয়ে আমার বই র মধ্যে রেখে ছিলাম । সে তখন ক্লাসে ছিল না । ক্লাসে এসে অঙ্কের বই ছেঁড়া দেখে সে কান্না শুরু করেদিল । আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম । স্যার আমাদের পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছিলেন । তিনি নতুন বই দেব বলে তাকে শান্ত করিয়েছিলেন ।
পরে সে একটা নতুন অঙ্কের বই পেয়েছিল ।
টিফিনের সময় স্যাররা আমাদের দিকে খুব নজর রাখতেন । টিফিনে বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে যেতাম । আমরা মাঠে খেলতাম । গাছে ওঠা নিষেধ ছিল । গরম কাল এলেই হেডস্যার আমাদেরকে স্মরণ করাতেন । টিফিনের পর হেড স্যারকে জিব দেখিয়ে ক্লাসে ঢুকতাম । হেড স্যার দরজার সামনে ছড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন । জিব কালো দেখলে পিঠে ছড়ি পড়ত । তার মানে সে গাছে উঠে জাম পেড়ে খেয়েছিল । একদিন টিফিনে জাম গাছে উঠে ডালে ধরে বেশ করে দোল খেলেছিলাম । তারপর স্কুলে গিয়ে ক্লাসে ঢোকার আগে স্যারকে জিব দেখালাম । কালো দাগ নেই । স্যারকে বলে ফেলেছিলাম :জাম খাইনি গাছে উঠেছিলাম ‘। স্যার হেসে ফেলেছিলেন । ‘ভালো করেছিস ,আয়, তোর পিঠ বাদ যায় কেন’ বলে আমার পিঠে কঘা পড়েছিল । সেই দুষ্টুমি কখনও ভোলা যায় ! একদিন টিফিনের সময়ে চায়নাদের বাড়িতে গিয়ে নোড় কুড়িয়েছিলাম । নুন দিয়ে খেতে ভালো লাগে ।
তাদের বাড়িতে একটা বড় নোড় গাছ ছিল । ক্লাসে ঢুকে জানতে পারলাম সে হেড স্যারের কাছে অভিযোগ করেছে আমি নাকি তাদের গাছ থেকে নোড় পেড়েছিলাম । ভয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম । হেড স্যার ক্লাসে আমাকে আর বকেনি । আমি নোড় পাড়ি নি । ঝরা নোড় কুড়িয়েছিলাম । মিথ্যা অভিযোগ করার জন্যে তার প্রতি আমার খুব রাগ হয়েছিল ।
টিফিনের সময় কখনও একটা করে পাউরুটি পেতাম । মাঝে মাঝে খিচুড়ি খেতাম । খিচুড়ির জন্যে তখন পাঁচ পয়সা করে জমা দিতে হত । টিফিনের সময় বাড়ি থেকে থালা নিয়ে আসতাম । লাইব্রেরীর সিমেন্টের বারান্দায় লাইন দিয়ে বসে খেতাম । স্কুলের সামনে আমাদের ওই সরকারি লাইব্রেরী । পাঁচ পয়সা জোগাড় করতে না পারলে জিবের জলে চোখের জলে ফিরে আসতে হত । তখন কি সব নিয়ম ছিল !
রাতে জেঠিমার কাছে শুতাম । জেঠিমা পান চিবিয়ে নরম করে একটু করে আমার গালে দিতেন । তাঁর মুখের চিবানো নরম পান চিবাতে চিবাতে আমি তাঁর গলা জড়িয়ে গল্প শুনতাম । ‘শিশু ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে ।’ সোনার বাংলা নাকি বর্গীরা ছারখার করে দিয়েছিল । তাঁর কাছে গল্প শুনতে শুনতে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়তাম । আমাদের ক্ষুধার দেশে বর্গীর মতো কখন দুর্ভিক্ষ এসে থাবা মারতে শুরু করল । তাই টিফিনে রুটি, কখনওবা খিচুড়ি । দুর্ভিক্ষের টিফিন হলেও অমৃত ছিল । এখনকার ত্রাণের মতো গরল নয় । তখন এতো রাজনীতি ছিল না ।
আমাদের বেলায় ফোরের বৃত্তি পরীক্ষা উঠে গিয়েছিল । তাই আমরা ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম স্কুলে । অঙ্কের প্রশ্নে বৃত্ত আঁকতে বলা ছিল । উত্তর পত্রে কালির দোয়াতের ছিপি বসিয়ে বসিয়ে আমি যখন পেন দিয়ে বৃত্ত আঁকছিলাম হেড স্যার তখন দেখছিলেন । আমার জ্যামিতি বক্স ছিল না । আমার বৃত্তের ধারণা দেখে হেডস্যার ভালো বলে ছিলেন । তখন আমরা পরীক্ষার সময় কালির দোয়াত সঙ্গে নিয়ে যেতাম । ফোর পাশ করে আমাদের পাশের গ্ৰামে কড়ামনুরাজ হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছিলাম ।
অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন কে যায় ? সবৈতনিক সহ মোটা টাকা ডোনেশন দিয়ে এখন সবাই ইংলিশ মিডিয়াম মুখো । মায়ের ভাষা ভুলে ইংরাজী ভাষায় খাচ্ছে হাবুডুবো । মায়ের ভাষা ভুলে মাকে কখনো শ্রদ্ধা জানানো যায় ! এটাই নাকি এখন আভিজাত্য । এ দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়ালে কি হবে বাঙালি চিরকাল ইংরাজী ভক্ত । কিন্ত রাজ ভাষা শিখে দাস কখনও রাজা হয় ? এখন খুব দুঃখ লাগে আমাদের অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি দুয়ো রাণীর মতো অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে ।
সুবল সরদার
হরিশঙ্কর পুর
মগরাহাট
দক্ষিণ পরগণা