হুল উৎসবে মেতে উঠল সাঁওতাল সমাজ,
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
৩০ শে জুন তারিখটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ইতিহাসে এই দিনটি হুল দিবস বা সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস নামে পরিচিত। 'হুল’ শব্দের অর্থ হলো 'বিদ্রোহ'। এরসঙ্গে জড়িয়ে আছে সরল, সাধাসিধে সাঁওতালদের আবেগ। নিজেদের স্বাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য স্থানীয় জমিদার, সুদখোর মহাজন ও ইংরেজদের রাজস্ব নীতির বিরুদ্ধে সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের নাম হলো সাঁওতাল বিদ্রোহ।
পাহাড় ও জঙ্গল ঘেরা দামিন-ই কোহ অঞ্চলে নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে বাস করত সাঁওতালরা। কৃষিকাজ ছিল তাদের প্রধান জীবিকা। এরজন্য তারা কাউকে রাজস্ব দিত না। এবার সেইদিকে নজর পরে ইংরেজ কোম্পানি এবং তাদের দোসর স্থানীয় জমিদার ও সুদখোর মহাজনদের। রাজস্ব আদায়ের নামে তারা সাঁওতালদের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করে। তাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। বাধ্য হয়ে তারা ইংরেজ, জমিদার ও সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। সঙ্গে ছিল দুই বোন ফুলমণি মুরমু ও ঝানো মুরমু। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আশেপাশের ৪০০ টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহি মাঠে জড়ো হয় এবং কলকাতার অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করে। ভারতের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম গণপদযাত্রা।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন যুদ্ধ শুরু হয়। সাওতাঁলরা তাদের পরিচিত তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মরণপণ সংগ্রাম করলেও শেষ পর্যন্ত আট মাস পর ইংরেজ বাহিনীর আধুনিক বন্দুক ও কামানের কাছে হেরে যায় । ইংরেজরা ফুলমণি মুর্মুকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তাঁর লাশ রেললাইনের ধারে ফেলে রেখে যায়। প্রসঙ্গত এই ফুলমনিকে নিয়ে সাঁওতালদের গান রয়েছে। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে সাঁওতালরা আজও তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে সিধু নিহত হন এবং কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয়। যুদ্ধে চাঁদ মুর্মু ও ভৈরব মুর্মু প্রাণ হারান।
যুদ্ধে সাঁওতালরা পরাজয় বরণ করলেও ইংরেজ ও তার দোসরদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। তাইতো ১৬৭ বছর পরও বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষ আজও সাঁওতাল বীর সিধু-কানুদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ৩০ শে জুন দিনটি পালিত হয় হুল দিবস হিসাবে ।
যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে আউসগ্রাম ২ নং ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস কমিটির উদ্যোগে ভাল্কি অঞ্চলের মোলডাঙায় পালিত হয় হুল দিবস। নিজেদের চির পরিচিত ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে আশেপাশের গ্রামের সাঁওতালারা জড়ো হন মোলডাঙায়। হাতে থাকে তীর-ধনুক। মাদলের তালে নেচে ওঠে সাঁওতাল রমণীরা। তাদের সঙ্গে মাদল বাজিয়ে পা-মেলাতে দ্যাখা যায় আউসগ্রাম ২ নং ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যকরী সভাপতি অরূপ মিদ্দাকে। যদিও এবার প্রথম নয় দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আসছেন। অরূপ বাবু বললেন - আমরা এমন এক রাজ্যের বাসিন্দা যেখানে যেকোনো উৎসবে কার্যত একসঙ্গে মেতে উঠি। এ এক আলাদা আনন্দ।
আদিবাসী মাঝি সাঁওতার উদ্যোগে হুল দিবস পালিত হয় পূর্ব মঙ্গলকোটের চাণক অঞ্চলের সরুলিয়া কোলপাড়ায়। সেখানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। কখনো বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী সুমি সরেনের গানের তালে কখনো বা রেকর্ডের গানের তালে পা মেলায় সাঁওতাল রমণীরা। কচিকাচাদের নাচ উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে। অনুষ্ঠানে সাঁওতাল সমাজের চোদ্দজন 'মোড়ল'-কে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। এখানে বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চাণক অঞ্চলের প্রাক্তন প্রধান ভুলি হেমরম ও সাঁওতাল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সাঁওতাল সমাজের নিজস্ব পতাকা উত্তোলন করেন বাজিনাথ কিস্কু। সমগ্র অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী কোল সমাজ সেবা সমিতির সভাপতি পল্টু সরেন।
অন্যদিকে হুল দিবস উপলক্ষ্যে বনপাস-কামারপাড়ায় সাঁওতাল রমণীদের সঙ্গে মাদলের তালে নৃত্য করতে দ্যাখা যায় এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক সুভাষ মণ্ডলকে। তিনি বললেন- অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে খুব আনন্দ লাগছিল।
ভারত জাকাত মৈঞ্জহি পারগানা মহলের উদ্যোগে সুসজ্জিত সাঁওতাল নারী-পুরুষদের একটি পদযাত্রা বের হয় গুসকরা স্কুলমোড় থেকে এবং শেষ হয় ১৪ নং ওয়ার্ডের আলুটিয়া মাঠে। পদযাত্রায় পা মেলান পুরসভার চেয়ারম্যান কুশল মুখার্জ্জী, কাউন্সিলর সাধনা কোনার, বাবুলাল মার্ডি ও যমুনা শিকারী। পরে আলুটিয়া যোগ দেন অন্যান্য ভাইস চেয়ারম্যান বেলি বেগম সহ অন্যান্য কাউন্সিলররা এবং গুসকরা বিট হাউসের ওসি অরুণ কুমার সোম। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে সাঁওতালি রীতিতে তাদের বরণ করে নেওয়া হয়। এছাড়াও বরণ করা হয় সাঁওতালি সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে। এখানে সাঁওতালি সমাজের পতাকা উত্তোলন করেন কুশল মুখার্জ্জী। এখানেও একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বাবুলাল মার্ডি বলেন - আজকের এই দিনটার জন্য আমরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি।