Spread the love

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বিরল প্রতিভা

ফারুক আহমেদ

আধুনিক শিক্ষা প্রসার ঘটাতে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করেছেন নারী কল্যাণে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সংকট দূর করতে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর অবদান রেখেছেন অফুরন্ত। রোকেয়া চর্চা শুরু হোক সর্বত্র ঘরে ঘরে। নারীর অধিকার আদায়ের জন্য এবং নারীর বঞ্চনার প্রতীকও হয়ে উঠেছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি কখনও তাঁর নামের সঙ্গে বেগম ও সৈয়দ লিখতেন না। নারী ক্ষমতা রাখে প্রকৃত অর্থে সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলতে এবং মানুষের সেবায় এগিয়ে আসতে। উপযুক্ত উদাহরণ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। সমস্ত প্রতিরোধ উপেক্ষা করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া এবং নারীদের আধুনিক শিক্ষা দিয়ে শিক্ষিত করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সফল করতে স্কুল খুলে নয়া নজির সৃষ্টি করেছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে অধিক পরিচিত বাঙালি মননে। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আবির্ভাবে নারীরা পেয়েছিল সম্মান, সমঅধিকার আর মাথা তুলে বাঁচার অধিকার।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন উভয় বাংলার মুসলিম নারীসমাজের আলােকবর্তিকা জাগ্রত বিবেক। ভারতের মুসলিম সমাজ যখন অশিক্ষা ও কুসংস্কারের আঁধারে নিমজ্জিত, অবরােধ ও অবজ্ঞায় এদেশের নারীসমাজ যখন জর্জরিত- সে তমসাচ্ছন্ন যুগে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর ন্যায় একজন মহীয়সী নারীর আবির্ভাব না ঘটলে এদেশের নারীশিক্ষা ও নারীজাগরণ সম্ভবপর হতাে না। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে আবির্ভাব হয়েছে মানব সমাজের কল্যাণে।

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর জেলার অর্ন্তগত পায়রাবন্দ গ্রামে রােকেয়া সাখাওয়াত হোসেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার এবং মাতার নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। পিতা আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং শিক্ষিত জমিদার ছিলেন। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা। রোকেয়ার তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। বড় দুই ভাইয়ের নাম মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের। দুজনেই ছিলেন বিদ্যানুরাগী। আর বড় বোন করিমুন্নেসা ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী। রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দু’ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল। এ পরিবারে পর্দাপ্রথা এত কঠোর ছিল যে পরিবারের নারীরা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও চাকরানি ছাড়া অন্য কোনাে স্ত্রীলােকের সামনেও বের হতেন না। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই রােকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকেও পর্দা প্রথা মেনে চলতে হতাে।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের শিক্ষাজীবন তেমন সুখকর ছিল। শিক্ষা লাভের জন্য তাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। তার পিতা আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল। রােকেয়ার পরিবারে স্ত্রীলােকদের একমাত্র কুরআন শরিফ ছাড়া অন্য কিছু পড়তে দেওয়া হতাে না। পরিবারের লােক উর্দু ভাষায় কথা বলত। পুরুষেরা বাইরে ফারসি ও বাংলা পড়ত। পরিবারের প্রথা অনুযায়ী রােকেয়াকে বাড়িতেই কুরআন শরিফ পড়তে দেওয়া হয়। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাস করার সময় একজন মেম শিক্ষয়িত্রীর নিকট তিনি কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনদের ভ্রুকুটির জন্য তাও বন্ধ করে দিতে হয়।

মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে পিতার এরূপ আচরণ রোকেয়াকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অন্যান্য বিদ্যাশিক্ষা করার জন্য রােকেয়ার মন ছটফট করতে থাকে। তার বড় দুই ভাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করার সুবাধে ভাইদের সহায়তায় তিনি বাড়িতে পড়াশোনার সুযোগ লাভ করেন। পিতা বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার ঘােরবিরােধী বলে রােকেয়া সাখাওয়াত হোসেন দিনের বেলায় পড়াশােনার সুযােগ পেতেন না। সেজন্য রাত্রিতে পিতা ঘুমালে ভাই সাবের বােনকে পড়াতেন এবং লিখতে শেখাতেন। এভাবে ভাইয়ের কাছে রােকেয়া সাখাওয়াত হোসেন গােপনে গােপনে লেখাপড়া শিখতে লাগলেন।
উদার আকাশ থেকে প্রথম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সম্মাননা প্রদান করা হয় ড. মীরাতুন নাহারকে। রোকেয়া গবেষক হিসেবে ড. নাহার উভয় বঙ্গে ক্রমশ পরিচিত মুখ। ইতিমধ্যেই তাঁর লেখা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে গ্রন্থ ‘জীবনশিল্পী রোকেয়া’ প্রকাশিত হয়েছে উদার আকাশ থেকে। বর্ধিত এডিশন প্রকাশিত হয়েছে গাঙচিল থেকে।

১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। রোকেয়ার শৈশব কাল কষ্টে কাটলেও বৈবাহিক জীবন ছিল আনন্দের। কারণ স্বামীর সাহচর্যে এসেই রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়। উদার ও আধুনিক মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। কিন্তু স্বামীর সেই আশীর্বাদ বেশি দিন রোকেয়ার ভাগ্যে জুটেনি। কোমল বন্ধুর ন্যায় নরম হাতটি রোকেয়াকে ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমায়। ১৯০৯ সালের ৩ মে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন। স্বামীর মৃত্যু এবং ইতোপূর্বে তাঁদের দুটি কন্যাসন্তানের অকালেই মারা যাওয়া, সব মিলিয়ে রোকেয়া নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাহিত্যচর্চা শুরু হয় তার স্বামীর হাত ধরেই। তাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় রোকেয়ার জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম হয়। সাহিত্যিক হিসেবে তৎকালীন যুগের প্রেক্ষাপটে রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তার প্রথম লেখা ঠিক কবে কোথায় প্রকাশিত হয় তা নিয়ে কিছু মত পার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে নবনূর পত্রিকায়। আবার অনেকেই মনে করেন প্রথম লেখা ‘পিপাসা’ (মহরম) প্রকাশিত হয় ইংরেজি ১৯০২ সালে নবপ্রভা পত্রিকায়। এরপর একে একে লিখে ফেলেন মতিচূর-এর প্রবন্ধগুলো এবং সুলতানার স্বপ্ন-এর মতো বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। ১৯৫০ সালে প্রথম ইংরেজি রচনা “সুলতানাজ ড্রিম বা সুলতানার স্বপ্ন” মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। সবাই তার রচনা পছন্দ করে। তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

স্বামী ও কন্যা সন্তানের মৃত্যুর পর রোকেয়া নিঃসঙ্গ হয়ে যান। শৈশবের সকল বাধা-বিপত্তির অবসান ঘটিয়ে বৈবাহিক জীবনে সুখের আলোর দেখা মিললেও সে আলো বেশি দিন তাকে আলোকিত করে নি। নিঃসঙ্গ রোকেয়া স্বামীর অনুপ্রেরণাকে বুকে ধারণ করে নিজেকে নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায়, স্বামীর দেওয়া অর্থে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে ১৯০৯ সালে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার কারণে স্কুল বন্ধ করতে বাধ্য হন। পরে কলকাতায় চলে আসেন। হার না মানা মহীয়সী এই নারী স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসার টানে ১৯১১ সালের ১৫ মার্চ আবারও চালু করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি চার বছরের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১০০ জনে পৌঁছুতে সক্ষম হন। ১৯৩০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটি পুর্ণাঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি রোকেয়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে, তিনি মুসলিম বাঙালি নারী সংগঠন আনজুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩০ সালে বেঙ্গল মুসলিম কনফারেন্সে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বিবৃতি দেন, যা সেই যুগের প্রেক্ষাপটে একটি দুঃসাহসিক কাজ ছিল।

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর জীনের মিল পাওয়া যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নারীর ক্ষমতা দখলের জন্য একটা ইতিহাস রচনা করছেন। নারী সমাজের কল্যাণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়া নজির সৃষ্টি করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছেন উদার মনের পরিচয় দিয়ে অফুরন্ত কাজ করছেন তিনি মানুষের কল্যাণে।
শৈশব থেকে মুসলমান নারীদের দুর্দশা রোকেয়া নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন বলেই তা নিরসনের জন্য পথে নামলেন। কারণ তিনি নিজেও নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে শৈশব কাটিয়েছিলেন। বাঙালি মুসলিম সমাজে নারী স্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতার প্রতিবাদে রোকেয়াই প্রথম কণ্ঠস্বর। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের শুরুতে তিনি ছিলেন নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণের প্রধান নেতা। মুসলিম সমাজের অন্ধকার যুগে নারী জাগরণে রোকেয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য, ব্যতিক্রমী। অবরোধের শৃঙ্খল ভেঙ্গে তিনি অসাধারণ সাহস, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বেরিয়ে আসেন। রোকেয়াই প্রথমবারের মতো বাঙালি মুসলিম সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকারের দাবি তুলে ধরেন এবং নারী স্বাধীনতার পক্ষে বক্তব্য রাখার সাহস পেলেন।
নারী আন্দোলনের ইতিহাসে রোকেয়ার অবদান চিরন্তন হয়ে আছে। রোকেয়া মুসলিম মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ১৯১৭ সালে আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতির ইতিহাসের সাথে রোকেয়ার সংগ্রামী জীবনের গল্প গভীরভাবে জড়িত। অনেক বিধবা মুসলিম মহিলা সমিতি থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন, অনেক দরিদ্র মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে, অনেক অভাবী মেয়ে সমিতির মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করেছে, সামাজিকভাবে পরিত্যক্ত অসহায় এতিমরা আশ্রয় ও সহায়তা পেয়েছে। শুধু তাই নয়, কলকাতার মুসলিম নারী সমাজের বিকাশের ইতিহাসে এই সমিতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

সাহিত্যিক হিসেবে তৎকালীন যুগের প্রেক্ষাপটে রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী বিরল প্রতিভা। ছোটবেলা থেকেই তিনি লিখালিখি করতেন। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিজ্ঞান সম্পর্কেও তাঁর অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন রচনায়। রোকেয়া সমকালীন যুগের বিদ্যানুরাগী সমাজহিতৈষী পুরুষ এবং মহিলাদের নিকট থেকে অনেক ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করেন। নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী, নবপ্রভা, মহিলা, ভারতমহিলা, আল-এসলাম, নওরোজ, মাহে নও, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, The Mussalman, Indian Ladies Magazine প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। রোকেয়ার সমগ্র সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কূফল, নারীশিক্ষার পক্ষে তাঁর নিজস্ব মতামত, নারীদের প্রতি সামাজিক অবমাননা এবং নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধেও তাঁর লেখা ছিল সোচ্চার। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর দুর্দশা এবং শারীরিক ও মানসিক জড়তা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় শিক্ষা। এ ধারণাই রোকেয়া তুলে ধরেন তীক্ষ্ণ ভাষায় ও তীর্যক ভঙ্গিতে। এক প্রতিকূল সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের খন্ড খন্ড চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর রচনায়। সমাজের নিচুতলার মানুষের জীবনের দুর্দশার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাঁর বহু প্রবন্ধ ও নকশাজাতীয় রচনায়।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের শৈশবকাল চার দেয়ালে আবদ্ধ থাকলেও জ্ঞানপিপাসা ছিল অসীম। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার ছিল না। গভীর রাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে মোমবাতির আলোতে বড় ভাইয়ের কাছে গিয়ে ইংরাজী ও বাংলায় পাঠ গ্রহণ করতেন। পদে পদে গঞ্জনা সহ্য করে এভাবেই রোকেয়া শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন নারীর অধিকার রক্ষার জন্য একমাত্র হাতিয়ার হল শিক্ষা। আর সেই লক্ষ্যকে মাথায় নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল। তাঁর স্কুলে মেয়েদের পাঠাবার জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি অভিভাবকদের অনুরোধ করতেন। যে যুগে মেয়েদের বাঙালি মুসলমানরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করত, সেই অন্ধকার যুগে রোকেয়া পর্দার অন্তরালে থেকেই নারীশিক্ষা বিস্তারে প্রয়াসী হন এবং মুসলমান মেয়েদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের পথ সুগম করেন। ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন সমাজকে আলোকিত করতেই তিনি বদ্ধপরিকর হয়েছেন।

স্কুলে তফসিরসহ কুরআন পাঠ থেকে আরম্ভ করে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, হোম নার্সিং, ফার্স্ট এইড, রান্না, সেলাই, শরীরচর্চা, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ই শিক্ষা দেওয়া হতো। নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তিনি অন্যান্য বালিকা বিদ্যালয়গুলোতে পরিদর্শন করতেন। তিনি নিজেই শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। শিক্ষকা হিসেবে তিনি ছিলেন অনেক উদার মনের। তখনকার সময় কলকাতায় ভালো শিক্ষয়িত্রী যেত না। তাই রোকেয়া মাদ্রাজ, গয়া, আগ্রা প্রভৃতি স্থান থেকে ভাল শিক্ষয়িত্রী নিয়ে আসতেন। যা নিতান্তই অনেক কষ্টের কাজ। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে সরকার কলকাতায় ‘মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল’ স্থাপন করে। স্কুলের জন্য সরকারি সাহায্য ও অনুদান আদায় করা ছিল অনেক দুরূহ কাজ। এর জন্য রোকেয়াকে অনেক কঠিন বাঁধা ও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়।

স্বামীর হাত ধরেই সাহিত্য জগতে পা রাখেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তার সব লেখাতেই নারী কল্যাণ চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। রোকেয়ার উলে­খযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে: Sultana’s Dream। যার অনূদিত রূপের নাম সুলতানার স্বপ্ন। যা ১৯০৫ মাদ্রাজের দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন (The Indian Ladies’ Magazine)-এ প্রকাশিত হয়। এটিকে বিশ্বের নারী জাগ্রত সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলি হল : মতিচূর (১৯০৪), পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধ-বাসিনীতে (১৯৩১)। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা তাঁর অসংখ্য চিঠিপত্র রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর গভীর মমত্ববোধ। সে যুগের অভিজাত শ্রেণীর মুসলমানদের ভাষা ছিল উর্দু। কিন্তু রোকেয়া উপলব্ধি করেন যে, এদেশের অধিকাংশ মুসলমানের ভাষা বাংলা। তাই বাংলা ভাষা ভালভাবে আয়ত্ত করে এই ভাষাকেই তাঁর বক্তব্য প্রকাশের বাহন হিসেবে ব্যবহার করেন। ১৯২৭ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল দুঃসাহসিক কাজ। বাংলা জুড়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রাখতে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন সেই সময়ে। বাংলা ও বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রামের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষা প্রসার ঘটাতে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করেছেন।

নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং আলোর দিশারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন জীবনকাল ছিল মাত্র ৫২ বছর। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। উত্তর কলকাতার সোদপুরে তাঁর সমাধি রয়েছে।

প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর তার জন্মদিনে ‘রোকেয়া শিক্ষা দিবস’ পালিত হওয়ার ডাক দিয়েছে ভূমি নামক একটি সংগঠন এবং নারী উন্নয়নে অবদানের জন্য বিশিষ্ট নারীদের রোকেয়া পদক প্রদান করা হয় বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে।

২০০৪ সালে, রোকেয়া বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ ভোটে ষষ্ঠ ভোট পেয়েছিলেন। সেই জরিপে প্রথম নামটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের।

বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণে এবং প্রথম বাঙালি নারীকল্যাণে বড় দায়িত্ব পালন করেছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। যার আবির্ভাবে নারীরা পেয়েছিল সম্মান, সমঅধিকার। মোমবাতির আলোতে যিনি লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়ের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন, তিনি আজ প্রত্যেক নারীর হাতে তুলে দিয়েছেন আলোক বর্তিকা। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন, সন্তানকে হারিয়েছেন কিন্তু কখনো মনোবল হারাননি। শিক্ষাই পারে নারীকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে একথা বুকে লালন করে সারাটা জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন নারীর মুক্তির জন্য আধুনিক শিক্ষা। রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন। নারী দাসী নয় বরং নারী এ সমাজের অর্ধাঙ্গ। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রত্যেক নারীর কাছে উদাহরণ হয়ে থাক। বাঙালি গর্বিত হতে ঘরে ঘরে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর জন্ম সার্বিক সার্থকতা পাক। বাঙালির ঘরে ঘরে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর মতো রাজকন্যারাই ফিরে ফিরে আসুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *