রেল কি সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণের পথে?
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
বেসরকারিকরণের ইঙ্গিত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রেলের বিভিন্ন কর্মী সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তাদের আশঙ্কা ধীরে ধীরে বিভিন্ন পদের বিলোপ ঘটিয়ে অচিরেই রেল দপ্তরকে পুরোপুরি বেসরকারি সংস্হার হাতে তুলে দেওয়া হবে। বিভিন্ন ভাবে তার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে।
এতদিন বিভিন্ন স্টেশনে দ্যাখা যেত 'থ্রু পাস' মেল, এক্সপ্রেস বা মালগাড়িকে সবুজ পতাকা দ্যাখাচ্ছে নির্দিষ্ট রেলকর্মীরা। এখন বেশ কিছু স্টেশনে সেই কাজ করছে কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টার বা সহকারী স্টেশন মাস্টার। কারণ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারীর অভাব।
একটা কথা বারবার শোনা যায় - চালু হওয়ার পর কখনোই নাকি বন্ধ হয়নি স্টেশন মাস্টারের অফিসের দরজা, থানা ও হাসপাতালের ইমারজেন্সির দরজা। এবার সেই সম্ভাবনা দ্যাখা গিয়েছিল। পর্যাপ্ত স্টেশন মাস্টার না থাকার জন্য কিছুদিন আগে দেশের সমস্ত স্টেশনের স্টেশন মাস্টাররা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। যাইহোক অনিবার্য কারণবশত সেটা হয়নি এবং হলে হয়তো রেলের যাত্রী পরিষেবা চরমভাবে বিঘ্নিত হতে পারত।
এদিকে বর্ধমানের মত গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে দ্যাখা গ্যালো একাধিক টিকিট কাউণ্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গুসকরা স্টেশনেও তাই। একটি কাউণ্টার বন্ধ। বেশ কিছু স্টেশন থেকে একই খবর পাওয়া যাচ্ছে। পরিবর্তে স্টেশনে অবস্হিত কিয়স্ক থেকে টিকিট কাটতে হচ্ছে। কাউন্টার বন্ধ করে দিয়ে সেগুলো হয়তো ধীরে ধীরে বেসরকারি সংস্হার হাতে তুলে দেওয়া হবে এবং এটাই বেসরকারিকরণের একটা ধাপ। অথবা অনলাইনে টিকিট কাটা বাধ্যতামূলক করে দিয়ে ঘুরপথে বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডারের বিপুল আয়ের পথ খুলে দেওয়া হবে।
জানা যাচ্ছে রেলের প্রায় আশি হাজার পদ নাকি বিলোপ করা হবে। অর্থাৎ যারা রেলে চাকরির কথা ভাবছিল এটা তাদের জন্য চরম হতাশাজনক খবর।
করোনার সময় নাম ছিল 'স্পেশাল ট্রেন'।
এখন আবার সব স্টেশনে থামা ট্রেনের গায়ে ‘এক্সপ্রেস’ স্ট্যাম্প মেরে দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আমন ধান কাটার মরশুম শুরু হতে চলেছে। তারপর শুরু হবে বোরো ধান চাষ। বিপুল সংখ্যক কৃষি শ্রমিক দিন পনেরো কুড়ির জন্য দৈনিক অন্যত্র যাবে। একটা বা দু’টো স্টেশন যাওয়ার জন্য কৃষি শ্রমিকদের পক্ষে ত্রিশ টাকা দিয়ে টিকিট কাটা সত্যিই কষ্টকর। আগে যেটা ছিল দশ টাকা। দুর্জনেরা বলে অযৌক্তিক ভাড়া বৃদ্ধির মূল লক্ষ্য বেসরকারিকরণ। কারণ কর্পোরেট সেক্টরগুলো অত্যধিক মুনাফা লাভ করতে চায়। ইতিমধ্যে কয়েকটি ট্রেন বেসরকারি সংস্হার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হয়তো দেওয়া হবে এবং সেগুলি চালাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের বড় ভরসা লোকাল ট্রেনগুলোকে যেকোনো স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টার দাঁড় করিয়ে রাখা হবে । যেমন এখন হয়। অর্থাৎ জনগণের করর টাকায় গড়ে ওঠা পরিকাঠামো ব্যবহার করে মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলবে বেসরকারি সংস্হাগুলো। কি সুইট না!
এখন আবার শোনা যাচ্ছে যাত্রীদের নাকি একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে স্টেশন চত্বরে ঢুকতে দেওয়া হবেনা। আগে এলে অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। নিত্যযাত্রীরা সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে আসে। তাদের খুব একটা অসুবিধা হবেনা। কিন্তু সাধারণ যাত্রীরা চরম সমস্যায় পড়বে। এমনকি একই সমস্যায় পড়বে চাকরি প্রার্থীরা। কারণ কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে তাদের পরীক্ষার কেন্দ্র পড়ে অনেক দূরে এবং তারা স্টেশনে রাত কাটাতে বাধ্য হয়।
একটা জিনিস লক্ষ্য করলে স্পষ্ট হবে - রেলের সব সিদ্ধান্ত যাত্রী বিরোধী। কিন্তু ট্রেন লেট করলে সাধারণ যাত্রীদের কি ধরনের ক্ষতি পূরণ দেওয়া হবে সেটা কিন্তু একবারও বলা হচ্ছেনা।
তবে এটাও ঠিক কাজের প্রতি এক শ্রেণির কর্মচারিদের চরম অবহেলার জন্য অনেক সময় কর্তৃপক্ষকে চরম সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেমন দ্যাখা যায় বিএসএনএল- এর ক্ষেত্রে। কাজের প্রতি অবহেলার জন্যই বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি আজ মোবাইল ফোনের জগতে জায়গা করে নিয়েছে। একটা সময় এই দেশে ফোনের জগতে একমাত্র বিএসএনএল ছিল। তখন ল্যান (LAN) ফোনের যুগ। ফোনের লাইনে গণ্ডগোল হলে বারবার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও সেটা সারানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কোনো সক্রিয় উদ্যোগ দ্যাখা যেতনা। এরসঙ্গে সরকারি নীতি তো আছেই। একই অবস্থা বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকের এক শ্রেণির কর্মচারিদের ব্যবহার। বারবার সমাজ মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, এমনকি স্টেট ব্যাংকের বিরুদ্ধেও, গ্রাহকরা ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছেনা। পরিস্থিতি বদলের জন্য সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। তবে মুষ্টিমেয় বেয়াদব কর্মচারিদের জন্য ব্যাংক বা যেকোনো সরকারি সংস্হার বেসরকারিকরণ নিশ্চয়ই সমর্থন যোগ্য নয়। এরজন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী ও পদস্থ অফিসারদেরও দায়বদ্ধতা থেকে যায়।
যাইহোক বর্তমানে কর্মরত কর্মচারীরা যদি সচেতন না হয় তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্মের রেলে চাকরি করার স্বপ্ন কিন্তু অধরা থেকে যাবে। নিজেদের কাজের মাধ্যমে তারা যদি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে না পারে তাহলে অপেক্ষা করছে রেলের বেসরকারিকরণ।