মাধবডির সুন্দরপুর গ্রাম ধরে রেখেছে ঐতিহ্য
জ্যোতিপ্রকাশ মুখার্জি ;
গরীব গ্রাম হিসাবে পূর্ব বর্ধমান জেলার মাধবডিহি থানার সুন্দরপুর গ্রামের বাসিন্দাদের মনের মধ্যে একটা দুঃখ থেকেই গিয়েছিল। গ্রামে শতাধিক বাড়ি থাকলেও তারা বঞ্চিত ছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর আনন্দ থেকে। পুজোর সময় সারাবাংলা যখন আনন্দে মেতে উঠত তখন বিষণ্ণতার কালো মেঘ ভিড় করত সুন্দরপুর গ্রামের উপর। কিছুটা সংকুচিত ভাবে পাশের গ্রামে দুর্গাপুজো দেখতে যেতে হতো, তাতে আনন্দ থাকতনা। ছেলেরা যেতে পারলেও পাড়ার মেয়েদের একটা সমস্যা থাকতই। তারা স্বাধীনভাবে যেতে পারতনা। একই অবস্থা হতো বাচ্চাদের। এরফলে আক্ষেপ থেকেই গিয়েছিল। অবশেষে সেই আক্ষেপ দূর করতে এগিয়ে আসেন গ্রামের বাসিন্দা বিজয়কৃষ্ণ মালিক, লক্ষীনারায়ণ বাগ প্রমুখরা। আরও বেশ কয়েকজনও ছিলেন। তাদের অনেকেই আজ প্রয়াত। সবার সঙ্গে আলোচনা করে মোটামুটি টিমটাম করে দুর্গাপুজো শুরু হয়। এসব পঁচিশ বছর আগেকার ঘটনা।
একে গরীব গ্রাম, তার উপর দুর্গাপুজোর মত ব্যয়বহুল পুজো – সামলানো যাবে কি করে? চরম দুশ্চিন্তা। প্রত্যেকেই নিজেদের সাধ্যমতো চাঁদা দিয়ে অনাড়ম্বর পরিবেশে শুরু হয় পুজো। কোনোরকমে একটা অস্হায়ী চালা করে তার নীচেই রাখা হয় ‘মা’-কে। তাতে কিন্তু গ্রামের বাসিন্দাদের আনন্দের কোনো ঘাটতি থাকেনা। যতইহোক নিজেদের গ্রামের পুজো। এ এক আলাদা আনন্দ। ধীরে ধীরে অনেক পরিবর্তন আসে। নিজস্ব জায়গা কিনে গড়ে ওঠে দুর্গা মন্দির। পুজো পরিচালনা করার জন্য গড়ে ওঠে সুন্দরপুর সুকান্ত ক্লাব ও সৃজনী সাংস্কৃতিক সংস্হা। গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় তাদের হাত ধরে পুজো সত্যিকারের সার্বজনীন হয়ে ওঠে। সবাই মেতে ওঠে আনন্দে। শুরু থেকেই এখানে একপাটায় থাকেন ‘মা’, অসুর ও মহিষ। আলাদা আলাদা পাটায় থাকে সন্তানসন্ততিরা। নিয়ম মেনে সপ্তমীতে ঘট আনা হয়। প্রায় সমস্ত গ্রামবাসী ঘট আনার অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। এটাও এক বিরল দৃশ্য। এখানে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। ফলে ছাগ নয় অষ্টমীতে বলি হয় চালকুমড়ো ও আখ। দশমীতে আট থেকে আশি- ছেলে মেয়ে প্রত্যেকেই সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠে। তবে সেটা কখনোই বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়না। আর্থিক দিক দুর্বল হলেও বরাবরই গ্রামটি সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে খুবই সমৃদ্ধ। তাইতো শুরুর দিন থেকেই পুজোর চারদিন ধরেই চলে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাতে মূলত গ্রামের ছেলেমেয়েরাই অংশগ্রহণ করে। অবশ্য মাঝে মাঝে বহিরাগত শিল্পীরা সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। গ্রামের দলের যাত্রা হয়। অষ্টমীর দিন ধুনুচি নাচ দেখতে আশেপাশের গ্রাম থেকে বহু মানুষ এসে ভিড় করে। সেখানে মূলত গ্রামের মেয়েরা অংশগ্রহণ করে। জানা যাচ্ছে এবারই প্রথম ছেলেরাও ধুনুচি নাচে অংশগ্রহণ করবে। গ্রামের ছেলে উজ্জ্বল মালিকের নেতৃত্বে জোরকদমে তার মহরাও চলছে। প্রসঙ্গত এই উজ্জ্বলের নেতৃত্বেই গ্রামে বিভিন্ন উৎসবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। ছোট আকারের হলেও পুজোর সময় মেলা হয়। তাতেই কচিকাচাদের আনন্দ।
কথা হচ্ছিল ক্লাব তথা পুজো কমিটির সম্পাদক শিশির মালিকের সঙ্গে। তিনি বলেন – ‘গ্রামের মানুষদের আক্ষেপ দূর করার জন্য আমাদের গুরুজনরা দুর্গাপুজো শুরু করেন। আমরা সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। যদিও এখন নতুন প্রজন্ম দায়িত্ব পালন করে চলেছে। আমরা তাদের পাশে থাকছি। ফলে একটা সুন্দর মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে। গত তিন বছর ধরে সরকারি সাহায্য পাওয়ার জন্য আমাদের অনেক সমস্যা দূর হয়েছে’।