Spread the love

ফাটাকেষ্টর পুজোর ঐতিহ্য আজও অমলিন

কলকাতার কালীপুজোর কথা বললে প্রথমেই মনে আসে ফাটাকেষ্টর পুজোর কথা। জাঁকজমক, আলোর রোশনাই, চমক, বিখ্যাত মানুষদের উপস্থিতি, দেবীর মাহাত্ম্যের নানা কাহিনী – সব মিলিয়ে কালীপুজো আর ফাটাকেষ্ট যেন মিথ হয়ে উঠেছিল।

আসল নাম কৃষ্ণ চন্দ্র দত্ত। তিনি কিন্তু খ্যাত ফাটাকেষ্ট নামেই। খুবই সাধারণ পরিবারে জন্ম। বাবার ছিল পানের দোকান। প্রতিদিন ঠনঠনে কালীবাড়িতে গিয়ে মাকে প্রণাম করে আসতেন ফাটাকেষ্ট। তারপর একদিন নিজেই মেতে উঠলেন শক্তির আরাধনায়। শুরু করলেন কালী পুজো। সময়টা গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষ ভাগ। সেই থেকে আজও হয়ে আসছে ফাটাকেষ্ট প্রতিষ্ঠিত কালী পুজো।
ফাটাকেষ্টর ক্লাবের নাম নব যুবক সংঘ। কিন্তু সেই পুজো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল ফাটাকেষ্টর পুজো নামে। আজও লোকমুখে নব যুবক সংঘের কালী পুজো ‘ফাটাকেষ্টর পুজো’।

উত্তর কলকাতার কেশব সেন স্ট্রিট থেকে শাখার মতো বেরিয়েছে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট। কতোই বা চওড়া। মেরে কেটে দশ ফুট। সেই গলিতে পুজো ! গলি জুড়ে প্যান্ডেল হলেও ঠাকুর থাকতো উঁচু মন্ডপে। তাঁর নীচ দিয়ে অনায়াসে মানুষ যাতায়াত করতে পারে। এখনো সেই ভাবেই প্যান্ডেল হয়। মঞ্চ বাঁধা হয় কেশব সেন স্ট্রিটের ওপর। সেই মঞ্চে পুজোর ক’টা দিন চলে নানা অনুষ্ঠান।
ফাটাকেষ্টর পুজোর প্রতিমা গড়তেন কালীপদ পাল। এখন তাঁর ছেলে মাধব পাল এই প্রতিমা তৈরি করেন। প্রতিমার উচ্চতা ১৪ ফুট। গাঢ় নীল রঙের দক্ষিণাকালী। পুজোর শুরু থেকে যে ধরণের প্রতিমা গড়া হতো, আজও সেই এক ধাঁচের প্রতিমা গড়া হয়। রথের দিন হয় কাঠামো পুজো। মহালয়ায় খুঁটি পুজো।
বলা হতো ফাটাকেষ্টর মা কালী খুব জাগ্ৰত। কতো লোক মানত করতেন। মনস্কামনা পূর্ণ হলে দেবীকে সোনার অলঙ্কার দিয়ে সাজিয়ে দিতেন।
সেই সময় প্রতিমা নিরঞ্জনের অতো কড়াকড়ি ছিল না। প্রায় দু’ সপ্তাহ প্রতিমা থাকতো মন্ডপে। পুজো উপলক্ষে মানুষের ঢল নামতো কেশব সেন স্ট্রিট ও সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে। কলকাতা তো বটেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ আসতেন ফাটাকেষ্টর পুজো দেখতে।
তখন কলকাতার বিখ্যাত কালীপুজো বলতে ফাটাকেষ্টর পুজো। কয়েক পা গেলেই আরো একটা বড় কালীপুজো হতো। রাজনীতিবিদ সোমেন মিত্রর পুজো। দুই পুজোর মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই থাকতো। কিন্তু সব সময়ই বৈচিত্র্যের দিক থেকে এগিয়ে থাকতো ফাটাকেষ্টর পুজোই।

ফাটাকেষ্টর পুজো মানেই চমক। কলকাতাবাসী উৎসুক হয়ে থাকতেন এবারে ফাটাকেষ্ট কি চমক দেবেন ! কলকাতার পুজোয় ফাটাকেষ্টই প্রথম চন্দন নগর থেকে আলো নিয়ে এলেন।শ্রীধর দাসের সেই আলোকসজ্জা দেখে মুগ্ধ নগরবাসী। তারপর থেকেই শ্রীধর দাসের আলোকসজ্জার খ্যাতি বাড়তে থাকে।

ফাটাকেষ্ট নিজে পড়াশোনা না জানলে কি হবে, কালীপুজো উপলক্ষে প্রকাশ করতেন ম্যাগাজিন। প্রতিবছর একটি করে বিষয় নিয়ে এই ম্যাগাজিন বের হতো। চিন্ময় বঙ্গ, কলকাতার মানুষ, কলকাতা ৭৭, কলকাতা বণিক সমাজ, কলকাতার নট নটী, চেনা অচেনা কলকাতা, কলকাতার ছাপাখানা ইত্যাদি। বিষয় বৈচিত্র্যে সেই ম্যাগাজিন সকলের নজর কেড়েছিল। কলকাতার বিখ্যাত লেখক এবং ঐতিহাসিক এই ম্যাগাজিনে লিখতেন। শোনা যায় লেখার জন্য ফাটাকেষ্ট তাঁদের সাম্মানিক দিতেন পাঁচশো টাকা। সেই সময় যা ভাবাই যেত না। এই সমস্ত ম্যাগাজিন প্রকাশনায় সাহায্য করতেন বিজয় রায়, কমল চৌধুরী, পরিমল চৌধুরীর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

ফাটাকেষ্টর পুজোর আরো এক বড় আকর্ষণ ছিল রূপোলী পর্দার তারকাদের উপস্থিতি। বলিউড থেকে টলিউড। নায়ক, নায়িকা থেকে খলনায়ক। অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না থেকে শুরু করে দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র, বিনোদ খান্না, বিনোদ মেহরা, প্রেম চোপড়া – কে নয়! মহানায়ক উত্তম কুমার ছিলেন ফাটাকেষ্টর পুজোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সংগীত জগতেরও বহু মানুষ আসতেন ফাটাকেষ্টর পুজোয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আশা ভোঁসলে, রাহুল দেব বর্মণ, বাপী লাহিড়ী – অসংখ্য নাম। শুধু অভিনেতা অভিনেত্রী বা গায়ক গায়িকাই নয়, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনেদের উপস্থিতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো এই পুজো। সেই নিয়েও ছিল অনেক কাহিনী। একবার যোগীগুরু ওঙ্কারনাথ কাশী থেকে কলকাতায় এসেছেন। ইচ্ছা প্রকাশ করলেন মাকে দর্শন করার। সেই কথা শুনে ফাটাকেষ্ট নিজে তাঁকে কাঁধে বসিয়ে যদুনাথ বোস লেন থেকে নিয়ে এসেছিলেন পুজো মন্ডপে। ১৯৯২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ফাটাকেষ্টর মৃত্যু হয়। তারপর থেকে সেই রীতি ধরে রেখেছেন প্রবন্ধ রায় ওরফে ফান্টা। তিন দশক ধরে প্রতি বছর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে পুজো হয় ফাটাকেষ্টর মা কালীর। যেমন গত বছর উপস্থিত ছিলেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশিষ্ট আলোকচিত্র শিল্পী অনুপম হালদার, পৌর প্রতিনিধি সূপর্ণা দত্ত, অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু প্রমুখ।

ফাটাকেষ্টর কালীপুজো এবার ৬৭ তম বর্ষে পদার্পণ করলো। এখনো সেই পুরনো দিনের রীতিনীতি মেনে নিষ্ঠা ভরে পুজো হয়। আড়ম্বর হয়তো কিছুটা কমেছে। কিন্তু প্রায় সাত দশক আগে চালু হওয়া পুজোর ঐতিহ্য আজও বজায় রয়েছে। নব যুবক সংঘের সদস্যরা ফাটাকেষ্টর পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলেছেন আজও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *