ফাঁসি নয়, আরজিকর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসক ধর্ষণ – খুনে ‘দোষী’ সঞ্জয়ের আমৃত্যু কারাদণ্ড
মোল্লা জসিমউদ্দিন ,
সোমবার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুন মামলায় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাদন্ডের সাজা শোনাল শিয়ালদহ আদালত। এছাড়াও নির্যাতিতার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে ১৭ লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্যের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এর পাশাপাশি সঞ্জয় রায়কে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করেন বিচারক অনির্বাণ দাস ।গত ১৮ই জানুয়ারি তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল আদালত।এদিন সাজা ঘোষণা হলো। এই রায়ের বিরুদ্ধে সঞ্জয়ের পরিবার উচ্চ আদালতে আপিল করবেনা বলে জানিয়েছে। তবে নির্যাতিতার পরিবার আড়ালে থাকা অপরাধীদের বিচার চেয়ে আরও তদন্ত চেয়েছে । গত বছর ৮ আগস্ট। সোদপুরের বাসিন্দা এক তরুণী চিকিৎসক ছিলেন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নাইট ডিউটিতে। ওই রাতে শেষবারের মতো মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। ৯ আগস্ট সকালে হাসপাতালের সেমিনার হলে পাওয়া যায় তাঁর নিথর দেহ। অভিযোগ ওঠে, ধর্ষণের পর তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে।তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশ ১০ আগস্ট গ্রেপ্তার করে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে। অভিযুক্তের গ্রেফতারি রাজ্যজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মানুষের ক্ষোভ চরমে ওঠে।এই ঘটনার পর রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। ১২ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।সামাজিক এবং রাজনৈতিক চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। কলকাতা হাইকোর্টে সিবিআই তদন্তের দাবিতে মামলা করা হয়। ১৩ আগস্ট, হাইকোর্ট এই মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়।এই ঘটনার সুবিচার চেয়ে পথে নামে সাধারণ মানুষ। ১৪ আগস্ট রাত দখলের আন্দোলনে মহিলারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। বিভিন্ন বয়সের মানুষ সেই প্রতিবাদে অংশ নেন। এর পাশাপাশি, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।তদন্ত ও আন্দোলনের জেরে চিকিৎসা মহলেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। ২ এবং ৩ সেপ্টেম্বর জুনিয়র চিকিৎসকরা লালবাজার অভিযান করেন। ১০ সেপ্টেম্বর থেকে স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান আন্দোলন শুরু হয়।এই অবস্থার মধ্যে ১৪ সেপ্টেম্বর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের দাবি মেটানোর আশ্বাস দেন। এর পরেও উত্তেজনা কমেনি। তদন্ত চলাকালীন আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হয়।সিবিআই তদন্তের পর, গত ৭ অক্টোবর মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট পেশ করা হয়। ১১ নভেম্বর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮ জানুয়ারি, দীর্ঘ শুনানি শেষে বিচারক সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করেন।ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল হাসপাতালেরই তরুণী চিকিৎসককে। আদালতের নির্দেশে তদন্তভার গ্রহণ করেছিল সিবিআই।সিবিআই প্রথম থেকেই অভিষুক্ত সিভিক ভলেন্টিয়ারের ফাঁসির আবেদন করেছিল। চার্জশিটেও তাঁকে একা দোষী হিসেবে দাবি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ) ধারা, ৬৬ ধারা (ধর্ষণের এমন আঘাত করা, যে কারণে মৃত্যু হতে পারে) এবং ১০৩ (১) ধারায় (খুন) তথ্য প্রমাণ এনেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তবে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় সঞ্জয়ের ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে আদালতে জমা দেওয়া চার্জশিটে ঠিক কী কী যুক্তি দেখিয়েছে সিবিআই। যথা১/ সিসিটিভি ফুটেজ: সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, ৯ অগস্ট ভোরে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চারতলায় সঞ্জয় গিয়েছিল।২/মোবাইল টাওয়ার লোকেশন: ঘটনার দিন সঞ্জয় আরজি করের সেমিনার হলে গিয়েছিল, সঞ্জয়ের মোবাইল টাওয়ার লোকেশনও সিবিআইযের বড় প্রমাণ।৩/ লালারস: খুন হওয়া চিকিৎসকের দেহে মেলা লালারসের নুমনার সঙ্গে সঞ্জয়ের লালার মিল পাওয়া গিয়েছে ডিএনএতে। এছাড়াও ক্রাইম সিন থেকে উদ্ধার হওয়া ৪/ছেঁড়া ব্ল টুথ, যেটি সঞ্জয়ের ফোনের সঙ্গে কানেক্ট করা ছিল। বস্তুত, এই ব্লু টুথের সূত্র ধরেই সঞ্জয়ের নাগাল পেয়েছিল কলকাতা পুলিশ।এছাড়াও পুলিশ ব্যারাক থেকে বাজেয়াপ্ত করা ৫/সঞ্জয়ের পোশাকে রক্তের দাগ,৬/ সঞ্জয়ের দেহের ক্ষতচিহ্ন, ৭/ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া ছোট ছোট চুলগুলি- এসবের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে সঞ্জয়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করেছে সিবিআই।সোমবার দুপুর ২:৪৫ সাজা ঘোষণা করলেন শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনিবার্ণ দাস। ২১০ নং ঘরে সাজা ঘোষণা করে বিচারক দাস বলেন, -‘আপনাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে’। সঞ্জয় রায়য়ের অপরাধ ‘বিরলতম’ নয়। তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিচ্ছে আদালত।রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল জুনিয়র ডাক্তার থেকে নির্যাতিতার মা-বাবা, সারা দেশে শহর ও রাজ্যবাসী তাকিয়ে ছিল। অবশেষে ১৬৪ দিন পর বিচার পেলেন আরজিকরের নির্যাতিতা। আরজি কর কাণ্ডে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা সঞ্জয় রায়ের। বিএনএস- ৬৬ নম্বর ধারায় সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ আদালতের। নির্যাতিতার পরিবারকে ১৭ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। সেই সঙ্গে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে আদালত। সাজা শুনে আদালতে কেঁদে ফেললেন সঞ্জয় রায়। তাঁর আইনজীবী বলেন, -‘আপনাকে মৃত্যদণ্ড নয়, আমৃত্যু কারাবাস দেওয়া হয়েছে’। সঞ্জয় বলেন, ”আমার তো বদনাম হয়ে গেল।’বিচারক দাস বলেন, এই ঘটনা বিরলের থেকে বিরলতম নয়। তাই মৃত্যুদণ্ডের সাজা শোনানো যায়না। সেই জন্য আমৃত্যু কারাবাস দিয়েছেন। বিচারক দাস বলেন, ”আপনাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে। দোষীর আমৃত্যু কারাদণ্ড ছাড়াও সাত লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সব মিলিয়ে ১৭ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে। জরিমানার টাকা না দিলে পাঁচ মাস অতিরিক্ত কারাবাসের নির্দেশ। নির্যাতিতার বাবা অবশ্য জানান, -‘ক্ষতিপূরণ চান না’। তাঁর উদ্দেশে বিচারক বলেন, -‘আপনি মনে করবেন না টাকা দিয়ে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আইনের বিধান অনুযায়ী এই ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছি’।গত ৯ অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিভাগের সেমিনার হল থেকে মহিলা চিকিৎসকের দেহ উদ্ধার হয়। তাঁকে ধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ১০ অগস্ট টালা থানার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন সঞ্জয়। হাসপাতাল ও সেমিনার রুমের বাইরের সিসিটিভি ফুটেজে সঞ্জয় রায়কে সেমিনার রুমে ঢুকতে ও বেরতে দেখা গিয়েছে। এমনকী সঞ্জয়ের ছেঁড়া হেডফোনের অংশও সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছিল সেমিনারে রুমে ঢোকার সময় সঞ্জয়ের গলায় হেডফোনের ঝুলছিল। কিন্তু সেমিনার রুম থেকে বের হওয়ার সময় সঞ্জয়ের গলায় হেডফোন ছিলনা। সেই সব তথ্যের প্রমাণের ভিত্তিতেই সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করেছিল টালা থানার পুলিশ। এরপর আদালতে চার্জশিট পেশ করে ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারকে একমাত্র ‘অভিযুক্ত’ হিসাবে উল্লেখ করে সিবিআই। আদালতে তাঁর ‘সর্বোচ্চ শাস্তি’র আবেদন করেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আইনজীবী। নির্যাতিতার শরীরে ষে ক্ষত চিহ্ন সঙ্গে সঞ্জয়ের দাঁতের ছাপ মিলে গিয়েছিল। এমনকী সঞ্জয়ের লালারসের সঙ্গে নির্যাতিতা তরুণী স্যাম্পেল মিলে যায়। তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় তোলপাড় হয় বাংলা। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিবাদে উত্তাল হয় দেশও। ৫ মাস ১১ দিন পর বিচার পেল অভয়া। এই রায়ে জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে।