ফলতা প্রাথমিক বিদ্যালয় – যেন অন্য গ্রহের বিদ্যালয়
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে সমালোচনার শেষ থাকেনা। প্রতিটি বিদ্যালয় যেন নেই রাজ্যের বাসিন্দা। বাইরে থেকে বিল্ডিংগুলো দেখলে মনে হবে কোনো এক প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্মৃতি বহন করে চলেছে সেগুলো। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এত কম যে বিদ্যালয় বলে মনেই হয়না। কিন্তু এযেন সব দিক দিয়েই এক ব্যতিক্রমী বিদ্যালয়। বাইরে থেকে বিল্ডিংটা দেখলে মনে হবে কোনো এক কর্পোরেট সংস্হার সুসজ্জিত প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে এলাকার ধনী বাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। ভিতরের সুসজ্জিত দৃশ্য বা টয়লেটগুলো দেখলে মনে হবে কোনো এক সৌখিন মানুষের বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করা হয়েছে। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। আগামী দিনে এটাই হয়তো হয়ে উঠবে দর্শনীয় স্হান। এটা আদপে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফলতা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। সৌজন্যে বিদ্যালয়ের আটজন শিক্ষক-শিক্ষিকা যাদের কাছে বিদ্যালয়টি সন্তানতুল্য এবং অভিভাবকরা যারা বিদ্যালয়টিকে একান্তভাবে নিজের মনে করেন।
১৯৩৬ সালে বিদ্যালয় গড়ে উঠলেও সরকারি স্বীকৃতি মেলে ছ'বছর পর ১৯৪২ সালে। এলাকার হাটে বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল বলে অনেকেই সেটা 'হাটের স্কুল' বলতেন। পরে জনৈক প্রভাকর মল্লিক গ্রামের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার স্বার্থে তেইশ কাঠা জায়গা দান করলে হাট থেকে বর্তমান জায়গায় বিদ্যালয় সরে আসে। মাটির দেওয়াল ও টালির চাল দেওয়া বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। যদিও স্তম্ভ ছিল ইঁট দিয়ে তৈরি। দীর্ঘদিন ধরেই এই পরিকাঠামো বজায় ছিল।
নাম মাত্র ছাত্র নিয়ে শুরু হয় বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ মণ্ডল। শোনা যায় বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু নাকি মাঝে মাঝে বিদ্যালয়ে আসতেন এবং বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন। এটাও এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ক'জনের কপালে এই সৌভাগ্য জোটে!
১৯৯৯ সালে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে যোগ দেন তিলক নস্কর। ২০১০ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। তারপর থেকেই বিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তন ঘটে। এরপর স্কুলটিকে তিনি অভিনব উচ্চতায় নিয়ে যান। পাশে পান তার সহকর্মীদের।এমনকি মিড ডে মিলের রন্ধন কর্মীরাও বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন স্হানীয় মানুষ তথা অভিভাবকরা। মূলত এই সময়ই বিদ্যালয়ের স্বর্ণযুগ শুরু হয়।
একের পর এক পুরস্কার পেয়ে ভরে ওঠে বিদ্যালয়ের ঝুলি। ২০১২ সালে জোটে 'নির্মল বিদ্যালয়' পুরস্কার, ২০১৩ সালে 'শিশু মিত্র' পুরস্কার, ২০১৫ সালে জেলার 'সেরা বিদ্যালয়' শিরোপা, ২০১৭ সালে যামিনী রায় পুরস্কার। প্রবণতা যেদিকে ভবিষ্যতে হয়তো আরও পুরস্কার অপেক্ষা করছে। আপাতত লক্ষ্য নিজেদের পড়শোনার ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং রাজ্যের সেরা হওয়া।
বিদ্যালয়টিকে শিশু-বান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য নেওয়া হয়েছে অভিনব পন্থা। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শিশু মনস্তত্ত্বকে। শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করে তোলার জন্য সমগ্র বিদ্যালয় চত্বরকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে বাঘ, জিরাফ, ডলফিনের প্রতিকৃতি ও ছবি দিয়ে। শিশুরা যে এগুলো ভালবাসে। ঘরে-বাইরে, বারান্দায়, দেওয়ালে মনিষীদের বাণী এবং বর্তমান ঘটনাবলী সম্পর্কে তথ্য। প্রতিটি শ্রেণি কক্ষের দেওয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন বিষয়। ভারতের মানচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেওয়ালে, সিলিং সেজে উঠেছে সূর্য, তারা, নক্ষত্র দিয়ে। ঋতু বোঝাতে আঁকা হয়েছে বিভিন্ন ছবি। ব্ল্যাকবোর্ডের মধ্যেও আছে অভিনবত্ব- কোনোটি ঘরের আদলে, কোনোটি আবার পতাকার ধাঁচে তৈরি করা হয়েছে। সবদেখে মনে হবে যেন ছোটখাট একটা পার্ক।
পঠনপাঠন চালু রেখে বিদ্যালয়ে প্রতিটি মনীষীর জন্মদিন পালন করা হয়। পড়ুয়াদের সামনে সেই সব মনীষীর জীবন কাহিনী তুলে ধরা হয়। এতে প্রত্যেকে উৎসাহ বোধ করে। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা তো আছেই। আর এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো পড়ুয়াদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। প্রধান শিক্ষকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্হানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা বছরে অন্তত চারবার পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। সত্যিই এটা এক বিরল ঘটনা।
সরকারি তথ্যানুযায়ী রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়ার সংখ্যা যখন কমছে তখন এই বিদ্যালয়ে সেটা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাবে নতুন করে ভর্তি নেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের পড়ুয়ার সংখ্যা সাড়ে চার শতাধিকের বেশি। সংখ্যাটা যেকোনো জুনিয়র হাইস্কুলের কাছে ঈর্ষণীয়। কিন্তু একজন পার্শ্ব শিক্ষিকা সহ আট জন
শিক্ষক-শিক্ষিকার পক্ষে এই বিপুল সংখ্যক পড়ুয়ার দিকে নজর দেওয়া খুবই কষ্টকর।
তবে সবার সৌভাগ্য এই বিদ্যালয়ের অনেক উচ্চ শিক্ষিত প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী ভালবেসে প্রায়ই পাঠদান করেন। প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী মালা দেবী তাদের অন্যতম। যদিও এরজন্য তারা কোনো পারিশ্রমিক নেন না। বর্তমান যুগে এটাও এক ব্যতিক্রমী ঘটনা।
তবে এইসব স্বীকৃতি সহজে জোটেনি। এর পেছনে আছে প্রধান শিক্ষক সহ প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকার অক্লান্ত পরিশ্রম। প্রধান শিক্ষক ছাড়াও লিপিকা করণ, ধরিত্রী পুরকাইত, সবিতা মিস্ত্রী, মণিশ চক্রবর্তী, শুভাশিস হালদার, কুন্তল মণ্ডল, মৌসুমী প্রামাণিক - প্রত্যেকেই বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য প্রাণপাত করেন। দেখলে মনে হবে এটা যেন তাদের কর্মক্ষেত্র নয়, বাড়ি। পড়ুয়াদের যাতে কোনোরকম স্বাস্থ্য সমস্যা না হয় তার জন্য প্রধান শিক্ষক নিজের হাতে বিদ্যালয়ের টয়লেট পরিস্কার করেন। এমনকি রাঁধুনীরা পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ফুল ও সব্জী বাগানে হাত লাগান। স্বাভাবিক ভাবে সবার মিলিত প্রয়াসে পড়াশোনা, পরিচ্ছন্নতা ও আধুনিকতায় জেলার অন্যতম সেরা আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এই বিদ্যালয়।
কথা হচ্ছিল ফলতা সার্কেলের এস.আই (শিক্ষা) পিয়ালী বড়ুয়ার সঙ্গে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সহ প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি বললেন - ফলতা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় সত্যিই আমাদের গর্ব। এর উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে জানাই কুর্ণিশ।
তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিলক নস্কর মনে করেন বিদ্যালয়ের এই সাফল্যের পেছনে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী এবং প্রতিটি অভিভাবক ও স্হানীয় মানুষের অবদান আছে। তিনি বললেন - প্রত্যেকের সহযোগিতার জন্য আজ আমরা এই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি। তার আশা পরবর্তী প্রজন্ম একে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেবে।