পুলিশ,চোর ও বিশ্বকবি
*দিলীপ রঞ্জন ভাদুড়ী।
ইং ১১-০২-২০২২
ইং ১৯১৮ সাল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে তাঁর প্রিয় লেখার কলম টি খোঁয়া যায়। ওই কলমে তিনি তাঁর লেখালেখি করতেন। তিনি তাঁর এই পেন হারিয়ে যাওয়ার কথাটি সাহিত্য সভায় প্রকাশ করেছিলেন।তখন ভারত স্বাধীন হয় নি।ইং ১৯১৩ সালে রবি ঠাকুর নোবেল পুরস্কার ভূষিত
হয়েছেন।বিশ্বকবি কিন্তু পুরো মাত্রায় স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তৎ কালীন গোয়েন্দা দপ্তর তিনি কোথায় ভাষণ দিলেন
খেয়াল রাখতেন।তাঁর এই পেন হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপার টা পুলিশি
নজরে আসে। ঠাকুর তাঁর প্রিয় কলমটি ফিরে পাবার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। প্রায় মাস খানেক পর জোড়াসাঁকো থানার বড়বাবু রবি ঠাকুরের বাড়িতে গিয়ে একটি পেন দেখিয়ে জানতে চান এই পেন টি তিনি চেনেন কি না।বিশ্বকবি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন,তাঁর প্রিয় পেনটির দিকে।বড়বাবু বিশ্বকবির পুঙ্খানুপুঙ্খ জবানবন্দি নেন।তারপর ,থানায় ফিরে যাবার আগে বড়বাবুর কাছে
জানতে চাইলেন, কি করে তিনি তাঁর পেন টি ফিরে পেতে পারেন।
বড়বাবু সবিনয়ে জানিয়ে ছিলেন যে চোরাই মাল উদ্ধার প্রাপ্ত হলে ফেরত দেবার প্রতিবন্ধকতা গুলির কথা। আরও একমাস পর
লালবাজার থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আদালতে হাজিরা দেবার জন্য সমন পেলেন। হৈচৈ ব্যাপার।বিশ্বকবির আদালতে সমন। কবির বন্ধু ছিলেন সাহিত্যিক ও পেশায় উকিল শ্রী সৌরিন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়। তিনি
সরাসরি ছুটলেন হাকিম আনিসুজ্জামান খান সাহেবের এজলাসের চেম্বারে। তিনি বললেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে তিনি পেন ফেরত পাবার জন্য তলব করেছেন।তিনি আসলে জানতেনই না যে তিনি কবিগুরু রবি ঠাকুর কে তলব করেছেন।
ডাক পড়ল তদানীন্তন কোর্ট ইন্সপেক্টর শরৎ চন্দ্র ঘোষ সাহেবের। ঘোষ সাহেব হাজির হলেন খান সাহেবের সামনে। হাকিম সাহেব আদেশ দিলেন ” আইন সবার জন্য সমান। কিন্তু, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লক্ষ কোটি র
বিরলতম একজন। এই আইন তিনি না মেনে নিয়েই তাঁর পেন সনাক্ত করনের জন্য উপস্থিতির সমন রদ করলেন। কবিগুরু তাঁর প্রিয় পেনটি সরকারি কৌশলী মিস্টার সৌরিন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায় মারফত ফেরত পেলেন। কবিগুরু এই পেন দিয়েই
তাঁর বিশ্বজয়ী কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি লিখেছিলেন। বিলক্ষণ পুলিশ এই
মূল্যবান পেন টি চোরা বাজারের আড়ত থেকে উদ্ধার করছিলেন।
কোন চোর ধরা পরে নি।
ভেবে অবাক হই,কলকাতা পুলিশ ব্রিটিশ আমলে কি অসাধারণ দক্ষ ছিলেন। চোরাই জগতের সমুদ্র থেকে ঠিক মুক্ত টি
উদ্ধার করে এনেছিলেন। আমি ইং
১৯৭০ সালে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের চাকরি তে যোগ দিয়েছিলাম।
ভাগ্যের কি পরিহাস।ইং ২৪ শে মার্চ,২০০৪,আমি সিউড়ির ডি এস পি, ডি আই বি পদ সামলাচ্ছি। বীরভূমের জেলার পুলিশ সুপার রায় সাহেব সদলে দুমকা জেলার পুলিশ সুপারের সাথে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মিটিংয়ে বসেছেন। বেলা দুটো নাগাদ খবর এলো কবিগুরুর ইং ১৯১৩ সালে পাওয়া নোবেল প্রাইজ সহ বেশ কিছু মূল্যবান স্মৃতি চুরি হয়ে গিয়েছে। যৌথ মিটিং বানচাল হয়ে গেল। রায় সাহেব সদলে ছুটলেন বোলপুর। ওখানে পৌঁছনোর পর
পুলিশ সুপার রায় সাহেবের নির্দেশ মত বোলপুর থানার বড়বাবু মৃত্যুঞ্জয় ব্যানার্জি ও আমি অকুস্থল
অর্থাৎ সংগ্রহশালা য় ঢুকলাম। আজকাল সর্বাধুনিক ভাষায় যাকে জিরো গ্রাউন্ড বলে। সব দেখে মনে হল বাইরে থেকে জানালা ভেঙে এই চুরি হয় নি।ভিতর থেকেই এই চুরি হয়েছে। এই নিজের চোখে দেখা চিহ্ন ও সূত্র দেখে যা উপলব্ধি হয়েছিল,তাই রায় সাহেব কে জানিয়েছিলাম। এরপর হুহু করে বড় বড় পুলিশ সাহেব রা এসে পৌঁছতে শুরু করলেন বোলপুরে।
মাননীয় আই জি সাহেব সন্ধি মুখার্জি এসে উপস্থিত হলেন। স্পেশাল পুলিশ সুপার মাননীয়
শ্রী জয়ন্ত বসু সাহেব সি আই ডি
থেকে এসে উপস্থিত হলেন। জানা গেল সি আই ডি তদন্ত ভার নিচ্ছে।
উর্দ্ধতন পুলিশ সাহেব রা পয়েন্ট জিরো গ্রাউন্ডে পৌঁছে গেলেন। আমার দেখা অকুস্থলের নক্সা পাল্টে গেল।দুঃখ পেলেও খুশি হলাম জেনে যে আমার দৃষ্টি শক্তিতে কত খামতি।বোলপুরের সি আই তখন শ্রী শান্ত মিত্র।মৃত্যঞ্জয় ও শ্রী শান্ত মিত্র অত্যন্ত দক্ষ পুলিশ অফিসার ছিলেন। সি আই ডি কিন্তু সেদিন ই তদন্ত শুরু করলেন না। প্রাথমিক তদন্তের ভার পড়ল থানার বড়বাবু মৃত্যুঞ্জয় ব্যানার্জির উপর ও তদারকি তে সি আই সাহেব শ্রী শান্ত মিত্র। মিথ্যে বলব না এঁদের দুজনের সাথেই আমার সুসম্পর্ক ছিল।এঁরা দুজন কেস ডায়েরি লেখার আগে আমাকে সঙ্গে থাকতে বলেছিলেন।
কিন্তু,আমি নিজেকে অনুপযোগী মনে করে সবিনয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। তদন্ত টাই এলো মেলো শুরু হল, সি আই ডি এর পর এল ও তারপর সি বি আই। সি বি আই দাবি করে তাঁদের সূত্র মতাবিক আন্তর্জাতিক চোর চক্রের হাতে চলে গেছে, নোবেল পদক।
মধ্যে রাজ্য সরকার এই মামলার দায়িত্ব রাজ্য কে ফিরিয়ে দিলে নোবেল ফেরত পাওয়া সম্ভব বললেও, জাত্য অভিমানে সি বি আই রাজি হন নি। ব্রিটিশ আমলের কলকাতা পুলিশের দক্ষতা ও রাজনৈতিক চক্রপাকে
বর্তমান বাংলা পুলিশের তথা সি আই ডি ও কেন্দ্রীয় পুলিশ সিবি আই এর অদক্ষতার প্রতিচ্ছবি দেখে একজন প্রাক্তন পুলিশ কর্মী হিসেবে আমিও লজ্জিত ও কবিগুরুর কাছে ক্ষমা প্রার্থী।
তবে আমাদের উত্তর সূরীরা দেখছি তাঁদের দক্ষতা অনেক টা উন্নত করেছেন। আজকাল প্রায় দেখি বেশ সমাবেশের আসর করে মিডিয়ার সামনে চোরাই মোবাইল,টোটো, ও
অন্যান্য উদ্ধার প্রাপ্ত দ্রব্য আসল মালিক দের ফেরত দেওয়া হচ্ছে।
এর জন্য জোড়া সাঁকো থানার বড়বাবু র মত যাঁদের চুরি গিয়েছে
তাঁদের বলতে হয় না আইনি বেড়াজাল বা প্রতিবন্ধকতা র কথা। বিশ্বকবি জানতে পারেনি
তাঁর পেন কে চুরি করেছিল।তেমনি আজকের যে সব ভাগ্যবান
জাঁকজমকের মাধ্যমে তাঁদের চুরি
হয়ে যাওয়া সম্পদ ফেরত পান তাঁরাও জানতে চান না,কে চুরি করেছিল,কোথায় পেলেন! সহজিয়া আইন,সহজিয়া পদ্ধতি ও
মান উন্নয়ন। লেখালেখি, জমা খরচ,হিসেব,নিকেশ এসব বেশি করতে গেলে মোটেই লোকের উপকার করা সম্ভব নয় । চোর ও পুলিশ নিয়ে আজব অজানা জগৎ।দয়া করে,কেউ রহস্য ভেদের চেষ্টা করবেন না।বড় কাব্যময় পুলিশের জগৎ।