পুর নিয়োগ দুর্নীতিতে তৎপর সিবিআই অভিযানের গতি বাড়াচ্ছে ডিভিশন বেঞ্চের সময়সীমা কে মাথায় রেখে?
মোল্লা জসিমউদ্দিন,
দিল্লিতে একশো দিনের প্রকল্পের বকেয়া অর্থ দাবি আন্দোলন সেরে যখন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজভবন লাগোয়া এলাকায় তৃণমূলের ধর্ণা মঞ্চ চলছে।তখন রবিবার কার্যত ভোর থেকে সিবিআইয়ের অভিযান আছড়ে পড়লো রাজ্যজুড়ে। মূলত দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন পুরসভার প্রাক্তন ও বর্তমান চেয়ারম্যানদের বাড়িতে অভিযান চালায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। তবে এই অভিযানের অন্যতম দিক রাজ্যের নগরউন্নয়ণ ও পুরমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের বাড়ি।এদিন অবশ্য ফিরহাদ হাকিম নিজের বাড়িতেই ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়কালে তাঁকে সিবিআই – ইডির বিরুদ্ধে মুখর হতে দেখা যেত।ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে – গত সপ্তাহে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে লিপস এন্ড বাউন্ডসের সম্পত্তি মামলায় আরেক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি কে হুশিয়ারি দিয়ে নিদিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দক্ষ অফিসারদের দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করার নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের তরফে। প্রসঙ্গত, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি মামলায় অয়ন শীলের বাড়িতে ইডির অভিযানে শিক্ষক নিয়োগ ছাড়াও বিভিন্ন পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতির কাগজপত্র উদ্ধার হয়।এই কাগজপত্রের ভিক্তিতে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সিবিআই – ইডি কে তদন্তের নির্দেশ জারি করেন।এই তদন্ত কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চ সহ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ কার্যত হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ বহাল রাখে।এমনকি কলকাতা হাইকোর্টের নব নিযুক্ত বেঞ্চের বিচারপতি অমৃতা সিনহা এই দুর্নীতি মামলায় সিবিআই – ইডির তদন্ত রিপোর্টে ক্রমাগত ক্ষুব্ধ হন।এই বিচারপতি ইডির তদন্তকারী দলের কর্তা কে অপসারণের নির্দেশও দেন। পরবর্তীতে ডিভিশন বেঞ্চে সিবিআই – ইডি কে তদন্তের গতি বাড়ানোর নির্দেশ জারি করা হয়। এরপরই রবিবার কার্যত ভোর থেকে সিবিআইয়ের অভিযান আছড়ে পড়ে রাজ্য জুড়ে। এদিন দশ ঘন্টার কাছাকাছি কলকাতার চেতলা এলাকায় মন্ত্রী ও ফিরহাদ হাকিমের বাড়িতে অভিযান চালায় সিবিআই। তদন্তকারী পুর নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় প্রচুর নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে থাকে বলে জানা গেছে। ফিরহাদ হাকিম যেহেতু রাজ্যের পুরসভা বিষয়ক মন্ত্রী, এর পাশাপাশি কলকাতা পুরসভার মেয়র। তাই ফিরহাদের বাড়িতে সিবিআইয়ের অভিযান কে গুরত্বপূর্ণ বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা কলকাতা হাইকোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এই জেরা-তল্লাশির মুখে পড়া কলকাতার নাগরিকদের কাছে লজ্জার বিষয় বলে জানিয়েছেন।এর আগে নারদকাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছিলেন কলকাতা পৌরনিগমের মেয়র ফিরহাদ হাকিম । এবার রাজ্যে পৌরনিয়োগে গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি পদে দুর্নীতির তদন্তে সেই কেন্দ্রীয় সংস্থারই জেরা ও তল্লাশির মুখে পড়লেন কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পৌর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম । এই ঘটনায় ফিরহাদ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করলেন রাজ্যসভার এই সাংসদ । গত শুক্রবারই পৌর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষের বাড়িতে ইডি হানা দেয় । তাঁর বাড়ি ছাড়া আরও কয়েকজন পৌরপ্রধানের বাড়িতেও তল্লাশি চালায় ইডি । সেই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেন ফিরহাদ হাকিম।তিনি বলেছিলেন, “রাজনৈতিক স্বার্থেই ইডি-র এই তল্লাশি অভিযান । আমাদের সামাজিক সম্মানহানি করতেই এটা করা হয় । আমি দেখেছি ১২-১৪ জায়গায় ইডি তল্লাশি করেছে । মহামান্য আদালতের কাছে হাতজোড় করে বলতে চাই, আপনার কাছে ওরা (ইডি) যাই জমা দিক, তা আপনি শোনান । রাজনীতির জন্য সামাজিক সম্মানহানি করা হচ্ছে। আমার কেস তাই হয়তো দশ বছরের পর কিছুই হবে না।”সেদিন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী দাবি করেন, -‘ইডি কোনও প্রমাণ দিতে পারছে না । সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে, রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না । এখন শুধু মিডিয়া ট্রায়াল হয় । ফিরহাদ আরও বলেছিলেন, “কোনও প্রমাণ পাওয়া না গেলে, আদালতের এই সব কেস খারিজ করে দেওয়া উচিত । আমাদের দু-একজন নেতা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তৃণমূলকে টার্গেট করছে কেন্দ্রীয় এজেন্সি ।”তাঁর এই বক্তব্যের পর রবিবার সকালেই সিবিআই হানা খোদ মন্ত্রীর বাড়িতে । তবে এই অভিযান প্রসঙ্গে কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “এই ঘটনা কলকাতাবাসীর কাছে লজ্জার। যাঁরা এই সব দুর্নীতিপরায়ণ লোকজনকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন তাঁদের কাছেও লজ্জার । অতীতে কলকাতা কর্পোরেশনের একটা গরিমা ছিল। সেটা আমরা হেলায় হারিয়েছি । এখন কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের নাম শুনলে গোটা দেশের মানুষ নাক কুঁচকে থাকেন । এর জন্য দায়ী ভোটাররা । অন্য কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই ।” ছুটির দিন সাতসকালে পুরমন্ত্রীর বাড়িতে সিবিআই হানা। ‘কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক হিংসা’র প্রতিবাদে ফিরহাদ হাকিমের বাড়ির সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা ও মেয়রের অনুগামীরা। তাঁদের সাফ দাবি, ‘উনি আমাদের ভগবান। এখনই ববিদার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাক সিবিআই কর্তারা।’ পরে অবশ্য প্রায় দশ ঘন্টা অভিযানের পর সন্ধে ৬ টার দিকে ফিরহাদের বাড়ি ছাড়ে সিবিআই। ফিরহাদ হাকিমের অনুগামীদের প্রশ্ন, -‘ কেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বাড়িতে যাচ্ছে না কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা?’রবিবার সকালে নিজাম প্যালেস থেকে মোট ১০টি গাড়িতে বের হয়েছিলেন সিবিআই আধিকারিকরা। তার মধ্যে একটি গাড়ি মেয়র তথা মন্ত্রী ফিরহাদের চেতলার বাড়ির সামনে পৌঁছয়। মোট ৫-৬জন সিবিআই আধিকারিক ফিরহাদ হাকিমের বাড়িতে ঢোকেন। সঙ্গে ছিলেন এক মহিলা আধিকারিকও। মেয়রের নিরাপত্তারক্ষীদেরও তাঁর বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় বলেই অভিযোগ। চেতলায় মন্ত্রীর বাড়ি ঘিরে রেখেছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। এদিকে, ফিরহাদের বাড়িতে সিবিআই হানার কথা শুনেই অনুগামীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান । কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে হেনস্তা করার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন মেয়র তথা মন্ত্রীর অনুগামীরা।তাঁদের দাবি, ‘দিল্লিতে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার প্রতিবাদে ধরনা দিয়েছে তৃণমূল। তার বদলা নিতেই সিবিআইয়ের এই তত্পরতা। পুরোটাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।’ চেতলা এলাকার বাসিন্দাদের কথায়, ‘ববিদা আমাদের ভগবান। এলাকার জন্য উনি প্রাণ দিতে পারেন। ওঁকে অযথা হেনস্তা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন, শুভেন্দু-সহ বিজেপি নেতাদের বাড়িতে যাচ্ছে না কেন ইডি-সিবিআই?’ সবমিলিয়ে এদিন সকাল থেকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হানা ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়েছে চেতলা এলাকায়। ফিরহাদ হাকিমের মেয় প্রিয়দর্শীনি, মন্ত্রীর ব্যক্তিগত আইনজীবী গোপাল হালদারকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি অভিযানের সময় বলে অভিযোগ। ফিরহাদের আইনজীবী জানিয়েছেন, তিনি খবর পেয়ে এসেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনী তাঁকে ঢুকতে দিচ্ছে না। এমনকী, মন্ত্রীর মোবাইলও নিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে সূত্রের দাবি।পরে সাড়ে ৬ টার দিকে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সিবিআইয়ের অতি সক্রিয়তা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন ফিরহাদ।