দোকান সামলে হাতে কোরআন শরীফ লিখে অসাধারণ নজির হাদিসা বানুর/
আর্জি কোরআন শরীফটি সংরক্ষণের
জাহির আব্বাস:
বর্ধমান জেলার কাটরাপোতা গ্রামের এক মুসলিম মহিলা হাতে সমগ্র কোরআন শরীফ লিখে গড়লেন অবিশ্বাস্য নজির। নাম হাদিসা বানু। জানা গেছে, ইউটিউবে নাসিম আখতার নামে এক পাকিস্তানী মহিলার সূচিশিল্পে কোরআনকে লিপিবদ্ধ করার কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এই অসাধ্য সাধন কাজটি করেছেন।। অল্প বয়সে বিবাহের জন্য পড়াশুনা খুব বেশি দূর এগোয়নি। পড়েছেন সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। এখন তার তিন ছেলেমেয়েই মাদ্রাসায় পড়ে। স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রী। বড় ছেলের আরবী হাতের লেখা খুব সুন্দর। লকডাউনে ছেলে বাড়িতে থাকায় ছেলের কাছে চার মাস ধরে আরবী হাতের লেখা চর্চা করেন। এদিকে অভাবের সংসারে যাতে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আটকে না যায় বা কোনো কিছুতে অভাব বুঝতে না পারে, তাই বাড়ির লাগোয়া একটি মুদিখানা দোকানও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পরিবারটির সাথে সম্পর্ক থাকা মৌলানা বাকিবিল্লাহ্ সাহেব বলেন, এ যেন খোদা প্রেমের নেশায় পাওয়া। কারণ অভাবের সংসারে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং নবীর প্রতি নিখাদ ভালোবাসা তথা কোরআনের প্রতি অন্তরের ঐকান্তিক মোহাব্বত না থাকলে একাজ যে কখনোই সম্ভব নয় তা সহজেই অনুমেয়।
হাদিসা বানু জানিয়েছেন,” লকডাউন চলছে দোকানে বসে বসে টুকিটাকি খরিদ্দার সামলে যখনই সময় পেয়েছি পবিত্র অবস্থায় কোরআনকে সুন্দরভাবে যথাসাধ্য লেখার চেষ্টা করে গেছি। মাসের পর মাস কখনো ক্লান্তি বোধ করিনি। কখনো বিরক্তিও আসেনি। শুধুই মনে হয়েছে যুগে যুগে বহু হাফেজ কোরআনকে সংরক্ষণ করে চলেছেন, আমি হয়তো তাঁদের মতো স্মৃতিতে কোরআনকে ধারণ করতে পারিনি।কিন্তু আমি এ কোরআনকে আমার লেখনীর মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে সংরক্ষণ করে যেতে চাই।জানিনা আমার এই বাসনা কতটা পূর্ণ হবে। কারণ শুনেছি বিভিন্ন জায়গার মানুষ বিভিন্নভাবে পবিত্র কোরআনকে সংরক্ষণ করেছেন। তাদের কারো কারো কোরআন মক্কা-মদিনার সংরক্ষণশালায় স্থান পেয়েছে। আমার হাতের লেখা কোরআন অতদূর পর্যন্ত না পৌঁছালেও যাতে যেকোনো সংরক্ষনশালায় দ্রুত সংরক্ষণ করা যায় তারই পথ চেয়ে আছি। আসলে প্রথম অবস্থায় যখন আমি আরবী হরফে কোরআন লেখা শুরু করি, তখন জানতাম না কোন কালি কতটা স্থায়ী বা কোন পাতায় লিখলে সেটা বেশি স্থায়িত্ব হয়। শুকরিয়া, আজ আমি লিখে ফেলেছি বটে, কিন্তু সেই সাথে আবহাওয়া জনিত কারণ বা কোনো প্রকারে পোকামাকড়ে ক্ষতি করে দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই আমি চাই, এত পরিশ্রম লব্ধ ভালোবাসার ফসল আমার হাতের লেখা এই কোরআন সংরক্ষিত হোক বিশ্বের মাঝে।আশা করি, কোনো সহৃদয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবেন।
তিনি আরও জানান,এটি নাজেরা কোরআন নয়,হিফজ কোরআন। যার প্রতি পাতায় আয়াত শেষ হয়। লিখতে লিখতে প্রতি পাতার শেষে আয়াত শেষ করাও বেশ কষ্টকর। একটি শব্দও পরের পাতায় গেলে চলবে না। এ জন্য অনেক পাতাও নষ্ট হয়েছে। এ হেন শর্ত মাথায় নিয়ে প্রথম পাঁচ মাসে ১১ পারা ও বাকি চার মাসে ১৯ পারা ,মোট নয় মাসে আল্লাহ্ পাক আমায় এই কাজ সম্পন্ন করিয়েছেন।
ঘাটশিলা সিদ্দিকীয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রাক্তন সুপারিনটেনডেন্ট মৌলানা এহসানুল হক সাহেব ঘটনা শুনে আবেগ তাড়িত হয়ে বলেন, ” একজন মহিলা মাদ্রাসা মক্তবে না পড়েও এমন সুন্দর লেখনীর মাধ্যমে সমগ্র কোরআনকে যেভাবে তুলে ধরেছেন তাতে অবাক হই বৈকি! নিশ্চিত এতে আল্লাহর সাহায্য রয়েছে।” তাঁর এক আত্মীয়ের কাছ থেকে জানা গেছে, ” উনি নিজের হাতের লেখা কোরআনটিকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছেন যে নিজের কাছেই আমৃত্যু রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাঁধানোর পর দেখলেন, ভ্যাপসা ভাব আসছে। লেখা নষ্ট হবার আশঙ্কা রয়েছে। অনেকই তখন তাঁকে কোনো মিজিয়াম বা লাইব্রেরীতে সংরক্ষণের ভালো ব্যবস্থা থাকতে পারে বলে জানালে উনি তখন সেখান দিতে রাজী হন ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এখন তো উনি নিজের ভালবাসার জিনিসকে হারানোর আশঙ্কায় একপ্রকার মনমরা।উনি কখনোই বিষয়টি প্রচারে আনতে চাননি।কোরআনটির স্থায়িত্বের কথা ভেবে আমরাই জোর করেছি। “স্বামী সেখ সাইবুল জানান, ” স্ত্রীর এই কাজে আমি ভীষণ সন্তুষ্ট। কারণ, সারাদিন রাজমিস্ত্রির কাজে বাইরে থাকি। পরিশ্রম করে এমনিতেই আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকি। তাই স্ত্রীর এই মহৎ কাজে কাগজ – পেন কেনা থেকে শুরু করে মানসিকভাবেও উৎসাহ যুগিয়েছি। এখন চাই ওর ইচ্ছা পূরণ হোক।”