Spread the love

কাটোয়া শহরে ‘ডেলিভারি গার্ল’,

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,

   বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্হার দৌলতে গত কয়েকবছর ধরে 'হোম ডেলিভারি' শব্দটা বাংলা অভিধানে ভালভাবেই জায়গা করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে আরও অনেক ইংরেজি শব্দের মত এটাও বাংলা শব্দ হয়ে উঠেছে। লকডাউনের সময় অনেকেই নিজেরাই স্হানীয়ভাবে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। প্রথম প্রথম আসত শৌখিন দ্রব্য যেগুলো স্হানীয় বাজারে পাওয়া যেতনা। কালের নিয়মে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় প্রতিটি সামগ্রী মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে বাড়ির দরজায়। 'পার্সেল আছে' ডাক শুনলেই দেখা যায় 'ডেলিভারি বয়' দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। কিন্তু কোনো 'ডেলিভারি গার্ল'-কে দেখা যেতনা। এবার ওদের হাত ধরেই হয়তো সেই অভাবটা মিটতে চলেছে।অন্তত কাটোয়া শহরের বুকে ওরাই হতে চলেছে প্রথম 'ডেলিভারি গার্ল'। ওরা হলো কাটোয়া-দাঁইহাটের মান্টি দে ও পায়েল বালা- দুই অভিন্ন হৃদয় বান্ধবী।

         বছর তিনেক আগে দুই বান্ধবী  স্নাতক 'কমপ্লিট' করেছে। দু'জনেরই অভাবের সংসার। মাণ্টির বাড়িতে আছে বাবা, মা ও একটি ছোট বোন। বাবা একটি ছোট্ট কারখানায় কর্মরত। মা তাঁত বোনেন। অন্যদিকে পায়েলের বাড়িতে আছে বাবা, মা ও দাদা। বাবা ভ্যান চালক। মা গৃহবধূ। দাদা চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

        ওদিকে নিজেদের পড়াশোনার খরচ তোলার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের খরচ হিসাবে বাবা-মার হাতে কিছু টাকা তুলে দেওয়ার জন্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরই দুই বান্ধবী শুরু করে দেয় গৃহশিক্ষকতার কাজ। পাশাপাশি নিজেদের পড়াশোনাও চালিয়ে যায়। 

      হঠাৎ তাদের নজর পড়ে যায় একটা বিজ্ঞাপনের দিকে। একটি বেসরকারি কোম্পানি তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে কিছু 'ডেলিভারি বয়' নেবে। অথচ ওরা 'গার্ল'। সমস্ত দ্বিধাগ্রস্ত ভাব কাটিয়ে কিছুটা মরিয়া ভাবে কোম্পানির মালিককে ফোন করে মাণ্টি এবং ওর নির্দেশ মত দেখাও করে। যদিও মালিকের মত তাদের মনেও ছিল দ্বিধা। একে মহিলা তার উপর 'হোম ডেলিভারি'-র মত ভারি কাজ। কিন্তু অভাবের সংসারে যাদের জন্ম তাদের কি এসব ভাবা সাজে! মালিককে তারা বলে - পারব। তাদের দৃঢ়তা দেখে মালিকও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। শুরু হলো এক নতুন পথ চলার।

        সকাল হতে না হতেই দুই বন্ধু প্রতিক্ষায় থাকে কখন অফিস থেকে ডাক আসবে। ডাক আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হয়ে যায় অফিসে। তারপর ষাট-সত্তরটা পার্সেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে দুই বন্ধু। প্রাপকদের বাড়ি বাড়ি বিলি করতে থাকে তাদের নির্দিষ্ট বস্তু। গত একমাস ধরে কাটোয়া-দাঁইহাট এলাকার বাসিন্দারা দেখতে পায় দুই 'ডেলিভারি গার্ল'-কে।

      সংশ্লিষ্ট সংস্হার কর্ণধার বললেন- ওদের আবেদন দেখে চমকে গিয়েছিলাম। প্রথমত ওরা মহিলা, তারপর সাইকেলে ওত জিনিস বিলি করতে পারবে তো? গত এক মাস ধরে ওদের পারফরম্যান্স আমার সমস্ত ধারণা ভুল বলে প্রমাণ করে দিয়েছে। হয়তো ওদের দেখে আরও অনেক মহিলা সাহস পাবে, উদ্বুদ্ধ হবে। 

          মাণ্টির মা বললেন - প্রথমে একটু ভয় হচ্ছিল, ওরা পারবে তো? এখন বিশ্বাস হয়। আশীর্বাদ করি ওরা আরও সফল হোক।

       যেদেশের নারীরা মহাকাশে যাচ্ছে, প্লেন, যুদ্ধ বিমান, ট্রেন, বাস চালাচ্ছে সেই দেশের নারী হয়ে এইটুকু কাজ করতে পারবনা- কথা বলার সময় যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী লাগছিল মাণ্টিকে। তার বক্তব্য - আমাদের অভাবের সংসার। সৎ পথে যেটুকু আয় হচ্ছে সেটাই বাবার হাতে তুলে দিচ্ছি। এটা খুবই আনন্দের। একই কথা বলল পায়েল। তার বাড়তি সংযোজন - আমরা যা করছি নিজেদের সংসারের জন্য করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *