গুসকরা পুরসভা এবং উন্নয়ন ও সমস্যা
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
প্রতিটি ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন মূল উদ্দেশ্য হলেও চরিত্রগত দিক দিয়ে লোকসভা, বিধানসভার সঙ্গে লোকাল বডি বা স্হানীয় নির্বাচন হিসাবে পুরভোট ও পঞ্চায়েত ভোট সম্পূর্ণ আলাদা। লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে স্হানীয় সমস্যা সেভাবে গুরুত্ব পায়না। সেখানে দেশের সুরক্ষা, ভবিষ্যত অর্থনীতি ও বেকারত্ব দূরীকরণ নিয়ে দিশা, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। পঞ্চায়েত বা পুরভোটে গুরুত্ব পায় স্হানীয় সমস্যা।
শহর এলাকার মূল সমস্যা হলো রাস্তাঘাট, নিকাষী ব্যবস্হা, পানীয় জল, স্ট্রীট লাইট ইত্যাদি। ১৯৮৮ সালে পুরসভা হিসাবে গুসকরা তার যাত্রা শুরু করে। এরমধ্যে প্রথম কুড়ি বছর ছিল বামফ্রন্টের হাতে এবং বাকি সময়টা তৃণমূলের হাতে। তাসত্ত্বেও বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে উন্নতির অবকাশ থেকে গেছে। চেষ্টা করলে মানুষের বেশ কিছু চাহিদাও পূরণ করা যেতে পারত।
শুধু পুরসভা হিসাবে নয় ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য আজন্ম গুসকরার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নিকাষী ব্যবস্হা। যেটা দূর করা সত্যিই কষ্টকর। গুসকরার আকৃতিটা অনেকটা কড়াইয়ের মত- মাঝখানটা নীচু এবং দু'প্রান্ত উঁচু। উত্তরে আছে কুনুর নদী এবং দক্ষিণে আছে কাঁদর। শহরের সমস্ত জল এসে পড়ে কুনুর নদীতে। নদীর নাব্যতা খুবই কম। ফলে জল ধারণ ক্ষমতাও কম। আবার বর্ষার জল ধরে রেখে শুকা মরশুমে সেই জল ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে নদীর নিম্ন উপত্যকায় গেট নির্মাণ করা হয়েছে। সময় মত সেই গেট খুলে না দেওয়ার জন্য শহরের জল সরতে সময় লাগে এবং মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। শহরের বুকে জল জমে থাকার এটাও বড় কারণ। অবৈজ্ঞানিক ভাবে মেলবন্ধন সেতু নির্মাণও বর্ষার সময় শহরের জল নিকাষীর পথে বড় বাধা। স্হানীয়দের অভিযোগ নব্বইয়ের দশকে নদী সংস্কারটা সঠিকভাবে হলে হয়তো বর্ষাকালে দীর্ঘ সময় ধরে জল জমে থাকতনা এবং শহরবাসী দুর্ভোগের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেত। তিন দশক আগে পুরসভার স্বীকৃতি পেলেও এখনো শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাঁচা ড্রেনের সংখ্যা অনেক। যদিও বর্তমান বোর্ডের আমলে বেশ কিছু পাকা ড্রেন তৈরি হয়েছে। এখন দেখার, অতীতে না হলেও ভবিষ্যতের জন্য, নতুন বোর্ড বর্ষাকালে জমা জলের হাত থেকে শহরবাসীকে রক্ষা করার জন্য খড়গপুর আই.আই.টি-র মত কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটির সাহায্য নেয় কিনা? সেক্ষেত্রে হয়তো সমস্যার কিছুটা সুরাহা হতে পারে।
একটা সময় গ্রীষ্মকালে গুসকরায় পানীয় জল সমস্যা ছিল তীব্র। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গৃহস্হ বাড়ির টিউবওয়েলগুলি ছিল পানীয় জলের উৎস। আর ছিল কিছু সরকারি টিউবওয়েল। গ্রীষ্মকালে জল স্তর দ্রুত নেমে গেলে পানীয় জল পেতে এলাকাবাসীদের চরম সমস্যায় পড়তে হতো। সরকারিভাবে শহরে সেভাবে জল সরবরাহ হতোনা। জল সরবরাহের জন্য বর্তমান প্রশাসকমণ্ডলী চারটি পাম্প স্হাপন করেছে। এখন দেখার সেগুলি পানীয় জল সমস্যার সমাধান করতে পারে কিনা। ভূমিপত্র হিসাবে পূর্বতন বোর্ডগুলির কাউন্সিলরা সমস্যার বিষয়ে ওয়াকিবহাল হলেও তারা কেবল পারস্পরিক দোষারোপ ও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের মত শুধু প্ল্যান করে গেছে এবং ব্যর্থতার জন্য প্রথমে পূর্ববর্তী এবং ক্ষমতা হারানোর পর পরবর্তী বোর্ডের দিকে আঙুল তুলেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধানে দূরদর্শীতার পরিচয় দিতে পারেনি। এক্ষেত্রেও বর্তমান বোর্ড অর্থবহ ভূমিকা পালন করলেও নতুন বোর্ডকে পানীয় জল সমস্যা নিয়ে ভাবতেই হবে।
দিনের পর দিন লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরে ফাঁকা জায়গা কমছে। কমছে জলাশয়। পৌরসভা হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার ত্রিশ বছর পরেও শহরের বুকে গড়ে ওঠেনি অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্হা। কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে বড় বিপর্যয় ঘটে যাবে। অবিলম্বে অগ্নি নির্বাপন কেন্দ্র গড়ে তোলার দিকে নজর দিতেই হবে।
শুধু স্হানীয়রা নয় আশেপাশের বহু এলাকার মানুষ চিকিৎসার জন্য গুসকরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল হলেও এখনো পর্যন্ত সেটার পরিকাঠামোগত উন্নতি হলোনা। বাম আমল থেকে উন্নতির গল্প শোনা গেলেও সেটা নিছক গল্পই থেকে গেছে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্হানীয় তৃণমূল বিধায়ক দাবি করেছেন যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির উন্নতির জন্য স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীর হাতে কুড়ি কোটি টাকার প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে। দেখা যাক সেটা কবে বাস্তবায়িত হয়।
খাতায় কলমে গুসকরায় একটা ডাম্পিং গ্রাউন্ড থাকলেও অভিযোগ সেটা নাকি দখল হয়ে গেছে। অস্হায়ীভাবে গুসকরা নিউটাউন সংলগ্ন রটন্তী তলার পাশে গৃহস্থালি সহ শহরের বর্জ্য পদার্থগুলো ফেলা হচ্ছে। এতে দৃশ্য দূষণের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ দূষণও ঘটছে। জানা যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি জৈব বর্জ্য পদার্থগুলোর সাহায্যে জৈব সার তৈরি করা হবে। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে গৃহস্থালির পচনশীল ও অপচনশীল জৈব পদার্থ সংগ্রহের জন্য পুরসভার পক্ষ থেকে প্রতি বাড়িতে নীল ও সবুজ রঙের দুটি বালতি দেওয়া হয়েছে।
গুসকরা শহরে কোনো কমিউনিটি হল নাই। এটা একটা বড় সমস্যা। বিনোদনের জন্য নাই কোনো হল। দুটি বেসরকারি হল সহ পুরসভা নির্মিত 'বিদ্যাসাগর' হল আছে। প্রথম দুটি আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যাসাগর হলটি একটি বেসরকারি সংস্হাকে 'লিজ' দেওয়া হয় এবং কার্যত সেটাও বন্ধ। বিনোদনের বিষয়টি পুর কর্তৃপক্ষকে মাথায় রাখতেই হবে।
শহরের সৌন্দর্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৌরসভার পশ্চিম দিকে অবস্হিত পুকুরটি প্রায় বুজে যাওয়ার মুখে। সেটি সংস্কার করে সৌন্দর্যায়নের দিকটা ভাবা যেতেই পারে। এছাড়াও অন্য জায়গাগুলোর কথাও ভাবা যেতে পারে।
বর্তমান বোর্ডের আমলে শহরের অধিকাংশ রাস্তা যথেষ্ট ভাল হলেও বেশ কিছু রাস্তার অবস্থা খারাপ। অভিযোগ সেগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তৈরি বা মেরামত করা হচ্ছেনা। ফলে তাড়াতাড়ি আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। গতির যুগে রাস্তা হলো 'লাইফ লাইন'। সুতরাং রাস্তার উন্নতির জন্য আরও সক্রিয় হতে হবে।
পার্কিং সমস্যা শহরের অন্যতম সমস্যা। যেখানে সেখানে টোটো, মোটর ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকছে এবং যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। রেলগেট ও রটন্তী ব্রিজের কাছে যানজট কুখ্যাত। জানা যাচ্ছে বর্তমান প্রশাসক মণ্ডলী ইতিমধ্যেই নাকি এই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করছে।
অধিকাংশ স্ট্রিট লাইট সক্রিয় থাকায় রাতের শহর থাকে আলো ঝলমলে। বিভিন্ন ইলেকট্রিক পোলে লাগানো হয়েছে রঙিন আলো। শহরের বেশ কয়েকটি হাইমাস্ট লাইট স্হাপন করা হয়েছে। অভিযোগ ঝলমলে আলোর পাশে শহরের কয়েকটি পাড়া এখনো অন্ধকারে ডুবে থাকে। মূল শহর থেকে দূরে থাকায় হয়তো সেভাবে চোখে পড়েনা।
শহরের বুকে চুরি, কেপমারি বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা 'ট্রেস' করার জন্য কয়েকবছর আগে বেশ কয়েকটি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। এখন নাকি সবগুলো অকেজো। এরফলে শহরের বুকে মাঝে মাঝে চুরির ঘটনা ঘটছে।
বর্তমান প্রশাসক মণ্ডলীর হাত ধরে গত দেড় বছরে শহরের প্রচুর উন্নতি হলেও সমস্যাও কম নয়। উন্নয়ন ও সমস্যাকে সামনে রেখে হতে চলেছে গুসকরা পুরসভার নির্বাচন। তিন মুখ্য দল হলো তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি ও সিপিএম। এখন দেখার ভোটলক্ষী কার প্রতি প্রসন্ন হয়।