Spread the love

এখনো ওরা ‘নেই’ রাজ্যের বাসিন্দা

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী

যেকোনো যুগেই বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রয়োজন ছিল আহারের। আদিম যুগে বনে বনে ঘুরে কেবলমাত্র খাদ্য সংগ্রহ করে মানুষ জীবন ধারণ করত। যাযাবর জীবন ছেড়ে মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হলো তখন লজ্জা নিবারণের জন্য প্রয়োজন হয়  বস্ত্র এবং আত্মরক্ষার জন্য বাসস্থানের। আধুনিক যুগে মাথার উপর ছাদ এবং চারপাশ ঘেরা - এইরকম একটা ঘরে নিশ্চিন্তে জীবন যাপনের স্বপ্ন দ্যাখেন প্রতিটি মানুষ। সবারই আবার স্বপ্ন পূরণের সামর্থ্য থাকেনা। তাদের জন্য এগিয়ে আসে দেশের সরকার। গরীব মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় ঘরবাড়ির ব্যবস্থা করে দ্যায়। কিন্তু আজও ওরা সেইসব থেকে বঞ্চিত। শুধু ঘরবাড়ি নয়, ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য নুন্যতম প্রয়োজনীয় আরও অনেক কিছু থেকেই ওরা বঞ্চিত।

 ওরা পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রাম ২ নং ব্লকের ভাল্কী-কুমীরখোলা গ্রামের বাসিন্দা। দু'দিকে ঘন জঙ্গল। বনের বুক চিরে আউসগ্রাম থেকে অভিরামপুর যাওয়ার রাস্তার একপাশে সদ্য এই গ্রাম গড়ে উঠেছে। গ্রাম না বলে পাড়া বলাই ভাল। ১৯-২০ টা বাড়ি এবং মোটামুটি সত্তর জন মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা বসতিকে আর যাইহোক গ্রাম বলা যায়না।

  স্থান-সঙ্কুলানের অভাবের জন্য মাস আট-নয় আগে ওরা মূল গ্রাম থেকে সরে এসে বনদপ্তরের খাস জমিতে বাড়ি তৈরি করে বাস করে। বাড়ি বলতে চারপাশ ছিটেবেড়া দিয়ে ঘেরা। মাথার উপর তালপাতার ছাউনি। কেউ কেউ আবার টিন অথবা এ‍্যাসবেস্ট দিয়ে ঘেরা ও মাথার উপর তারই ছাউনি দেওয়া বাড়ি করেছে। সেটাও আবার স্থানীয় মহাজনের কাছে ধার করে। ধীরে ধীরে ধার শোধ করতে হয়।

আয় বলতে লোকের জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ। সেখানেও কাজ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নাই। এখানে চাষাবাদ পুরোপুরি বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। যেমন এবছর বর্ষার সময় বৃষ্টির পরিমাণ খুবই কম। আবার সেচব্যবস্থার অপ্রতুলার জন্য  সেভাবে চাষাবাদ হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আয় কম। একশ দিনের কাজ করে কিছু আয় হবে সেই পথও বন্ধ। বিকল্প হিসাবে জঙ্গল থেকে শালপাতা সংগ্রহ করে বিক্রি করা হতো। কিন্তু কৃত্রিম পাতার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় তারও বিক্রি কম। ফলে আয় আরও কম। বর্তমান বাজারে সংসার নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বুড়ো বেশরার বক্তব্য - র‍্যাশনে বিনামুল্যে চাল, গম, আটা না পেলে বউ-ছেলে নিয়ে না খেয়ে মরতে হতো। সেক্ষেত্রে হয়তো বাম আমলে ঘটে যাওয়া আমলাশোলের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারত।

জলের অপর নাম জীবন। আমাদের রাজ্যে একটা সময় গ্রীষ্মকালে বাঁকুড়া বা পুরুলিয়া জেলার বাসিন্দাদের তীব্র জলকষ্টে ভুগতে হতো। এখন অবশ্য পরিস্থিতি অনেক পাল্টেছে। পাড়ার মধ্যে পানীয় জলের কল না থাকায় ভাল্কী-কুমীরখোলা গ্রামের বাসিন্দাদের প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে পুরনো গ্রাম থেকে জল আনতে হয়। বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় বিষয়টি খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে। 

পাড়ার মধ্যে বিদ্যুতের আলো নাই। ভরসা র‍্যাশনে পাওয়া সামান্য কেরোসিন তেল। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই চারদিক ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায়। শোনা যায় শেয়ালের ডাক। হাতি এলে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নাই। আগে ভয় লাগত। এখন সব অভ্যাস হয়ে গ্যাছে। সমস্যা হয় ছেলমেয়েদের পড়াশোনা করতে। দূরে দূরে যখন বিদ্যুতের আলো জ্বলছে ওরা তখন কেরোসিন তেলের সাহায্যে জ্বলা লণ্ঠনের আলোয় পড়ছে। তাও আবার খুব সামান্য সময়ের জন্য। তেল শেষ হয়ে গেলে শুধু পড়া বন্ধ হয়ে যাবেনা, পরের দিন থেকে অন্ধকারে থাকতে হবে। মাসে তো র‍্যাশনে একবারই তাও আবার সামান্য কেরোসিন তেল পাওয়া যায়। দু’চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখা দশম শ্রেণির ছাত্রী লক্ষীর আকুল আবেদন – সরকার থেকে যদি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে একটু বেশি সময় ধরে রাতের বেলায় পড়তে পেতাম। হয়তো সেক্ষেত্রে পরীক্ষার ফল ভাল হতে পারত। স্থানীয় প্রশাসন কি লক্ষীর আবেদন শুনতে পাচ্ছেন?

রান্না হচ্ছে বনের শুকনো ডালপালা দিয়ে। রান্নাঘর বলতে পলিথিন দিয়ে ঘেরা উঠানের মাঝে একটুকরো ছাউনি বিহীন জায়গা। বৃষ্টি হলে রান্না বন্ধ। সুতরাং উপোষ। জল খেয়ে শুয়ে পড়া। উজালা গ্যাসের কথা বলতেই আঁতকে ওঠে ওরা। তারপর অসহায় কণ্ঠে বলে - যেখানে দু'বেলা খাবার জোটাতে পারছিনা সেখানে গ্যাসে রান্না করার কথা ভাবাটা চরম বিলাসিতা। গ্যাস কেনার দাম কে দেবে শুনি? 

'দুয়ারে সরকার' হওয়ার সময় সরকারের দুয়ারে ওরা অনেকবার গ্যাছে। কিন্তু অনেক সমস্যার ওদের সমাধান হয়নি। জঙ্গলের মধ্যে বাস করলেও 'দিদির সুরক্ষা কবজ'-এর কথা ওরা শুনেছে। ওদের আশা এবার হয়তো 'দিদির দূত'-রা ওদের জন্য সুখবর নিয়ে আসবে। ওদের চাহিদা সামান্য- মাথার উপর ছাদ ও বেঁচে থাকার জন্য খাবার।

কথা হচ্ছিল আউসগ্রাম ২ নং ব্লক তৃণমূল সভাপতি রামকৃষ্ণ ঘোষের সঙ্গে। তিনি বললেন - বিষয়টি আমরা জানি। সমস্যা দূর করার জন্য আমি বেশ কয়েকবার ওদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছি। প্রশাসনের কাছে ওদের সমস্যা তুলে ধরেছি। দ্রুত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রশাসনও সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করছে। তিনি আরও বললেন - আমাদের বিধায়ক অভেদানন্দ থাণ্ডারও সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছেন। 

ব্লক সভাপতির কাছে জানা গ্যালো পানীয় জলের জন্য ওখানে খুব শীঘ্রই একটি পাম্প বসবে। ওদের জন্য সরকারি প্রকল্পে বাড়ির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিদ্যুতের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখন কবে ওদের প্রাথমিক সমস্যা দূর হয় তার জন্য শুধু অপেক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *