ছবিটা দেখলেই বোঝা যায় গ্রামের অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী, অভিভাবকদের কাছে কতোটা জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। আর সেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালীনই সরকারী নিয়মে দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নিলেন সারেঙ্গার নেতুরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ‘শিক্ষারত্ন’ প্রাপ্ত শিক্ষক সাধন মণ্ডল। শুক্রবার শেষবারের বারের মতো তিনি যখন স্কুলের হাজিরা খাতায় সই করছেন তখন তাঁর চোখে জল, হাতও বোধহয় কিছুটা বোধহয় কাঁপছিল, কিন্তু তার ঠিক কয়েক ঘন্টা পর এমন রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনা অপেক্ষা করছিল বোধহয় ভাবতে পারেননি তিনি। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক দু’টো বাজার আগেই বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে হাজির তাঁর অসংখ্য প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী, অভিভাবক সহ পূরো গ্রাম। উপস্থিত অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক (সারেঙ্গা) সোনালী মুর্মু নিজেও।

গ্রামবাসীদের সূত্রে খবর, ছাত্র দরদী এই শিক্ষকের কর্মজীবনের শুরু নেতুরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়েই।  মাঝের কিছুটা সময় স্থানীয় চাকনাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাটালেও ফের তিনি ফিরে আসেন এখানেই। তাঁর সময়কালেই জঙ্গল মহলের গ্রামের প্রত্যন্ত এই স্কুল পেয়েছে 'নির্মল বিদ্যালয় পূরস্কার'। শিক্ষককতার পাশাপাশি তামাক বিরোধী আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে এই শিক্ষকের। এলাকার মানুষ ভালোবাসে তাঁকে 'বাঘ মাষ্টার' হিসেবে ডাকলেও তাঁর মন শিশুর মতোই সরল। বিদায় সংবর্ধণা মঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে গ্রামবাসীদের কথারই প্রতিধ্বণী শোনা গেল অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক, সারেঙ্গা সোনালী মুর্ম্মুর গলাতেও। তিনি বলেন সাধন বাবুর মত প্রাণোচ্ছল শিক্ষক আমি খুব কম দেখেছি এই বয়সেও উনি যেভাবে দায়িত্বের সাথে দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করে তার দায়িত্ব পালন করেন এই জন্য উনাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই । বিদ্যালয়টিকে তিনি মন্দির ভেবে সাজিয়েছেন আর এই মন্দিরের দেবতা হল তার প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা আমি বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়ে এসে তার কর্মকাণ্ড দেখেছি উনাকে খুব  কুর্নিশজানাই। বাঁকুড়া জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক সন্দীপ কুমার মালিক বলেন এই বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানটি দেখে মনে হচ্ছে আমরা এক বিশেষ শিক্ষককে তার কর্ম জীবন থেকে অবসর দিচ্ছি এটা সরকারি নিয়মে কিন্তু উনি বাড়িতে বসে থাকতে পারবেন না বিদ্যালয়ে আসবেন এবং শিশুদের আগের মতোই পারতাম দেবেন এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।এত মানুষের সমাগমেই প্রমাণ করে দিচ্ছে সাধন বাবু মানুষটি কেমন ছিলেন। সাধন বাবুর শিশুদের প্রতি দরদ না থাকলে শিশুদের অভিভাবকদের এই শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হতো না। স্কুলে এসে শুনেছিলাম উনি খুব শাসন করতেন কিন্তু এই অনুষ্ঠানে এসে বুঝলাম শাসন করা তারই সাজে সোহাগ  করে যে।  শিশুদের চোখের জল ও অভিভাবকদের চোখের জলইতা প্রমাণ করে দিল। সহকারি বিদ্যালয় পরিদর্শক সঞ্জীব  দাস চক্রবর্তী বলেন সাধন বাবুর মত একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষকই নয় তিনি সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন  বিশিষ্ট সমাজসেবী ও তিনি বিভিন্ন সমাজ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত তার সেই সমস্ত কর্মকাণ্ড আরো বেশি বেশি করে পালন করুন এই কামনা করি। জঙ্গলমহল এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার শ্যামল কুমার দে বলেন সাধন আমার ছোট ভাইয়ের মতো ওকে আমি ১৯৯৮ সাল থেকে একান্তভাবে দেখে আসছি তার কর্মকান্ড গুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করে শুধু শিক্ষকতা নয় সে বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত তাছাড়া একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক।

'বিদায়ী' প্রধান শিক্ষক সাধন কুমার মণ্ডলের প্রাণ ভোমরা তাঁর ছাত্র ছাত্রীরাই।  সেকথা আরও একবার স্পষ্ট হলো তাঁর কথাতেই। আমাদের ক্যামেরার মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, আমৃত্যু এই ছাত্র ছাত্রীদের সাথেই কাটাতে চাই। আর সেকারণেই সরকারী নিয়মে অবসরের পর দিন থেকেই এই বিদ্যালয়ে আবার আসবো, আগের মতোই শিক্ষক হিসেবে আমাকে পাবে আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা। আজকের এই বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে নেতুরপুর  গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা হাজির হয়েছিলেন হাজির হয়ে সাধারণ বাবুকে কেউ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কেউ ভালোবাসা জানিয়েছেন কেউ জানিয়েছেন। এছাড়াও এছাড়া উপস্থিত ছিলেন এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকা বৃন্দ জামমনী হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক উজ্জ্বল মল্লিক রায়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মধুসূদন মন্ডল তত্ত্বদানদি বনমালী বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক প্রশান্ত আখুলি, বিশিষ্ট শিক্ষক তথা মৃৎশিল্পী বিশ্বনাথ কুম্ভকার, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অসিত মিদ্দা, অনুপ কুমার পাল, সারেঙ্গা বিবেকানন্দ শিক্ষা নিকেতনের অধ্যক্ষ জয়ন্ত খাটুয়া সহ বিশিষ্ট মানুষজন এখানে উল্লেখ্য এ দিন অনুষ্ঠান মঞ্চে হাজির ছিলেন সাধারণ বাবুর বৃদ্ধ মা  চাঁপা রানী মন্ডল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সত্যকিঙ্কর পন্ডা।

Leave a Reply