অন্তর-বাস,
সুজান মিঠি
ছেলেটির প্রেমিকা এসে কেঁদে পড়ল ছেলেটির বিছানার পাশে, কী করব বলো! আমি তো রাখতেই চেয়েছিলাম কিন্তু মা বাবা কিছুতেই…
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ছেলেটি বলল, অথচ তুমিই বলেছিলে, এ থাকবে। আমার অপারেশনের পরেই তো আমরা বিয়ে করতাম! কিন্তু মৃতের স্মৃতি শুধু ফটো ফ্রেমেই হওয়া উচিত। ঠিকই করেছেন তোমার বাবা মা…তোমার বিয়ে, সংসার সব তো বাকি!
ছেলেটির আধো বোজা চোখের উপরে ঢেউ খেলে যায় কচি ধানের শীষ। পিউ কাঁহা পাখিটা ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে গেল, আমার নাম পাপিয়া। শুনছ তুমি?
ছেলেটা একসময় কবিতা লিখত। ওর প্রেমিকা জুঁই ওকে কাব্য বলে ডাকত তাই। আজ ওদের ভালোবাসার ভ্রূণটাকে শেষ করতে এসেছিল এই হাসপাতালেই…
কী বলে ডাকল আজ সে তার কাব্যকে? নাহ ডাকেনি আজ। আর ডাকবেও না কোনদিন। ডাক্তার চৌধুরী যে আজ কেন এলেন না এখনও! ছেলেটি তাঁর কাছে রোজ একবার করে জেনে নেয় আর ঠিক কতদিন? আর কত ঘন্টা? ডাক্তার চৌধুরী রোজ তার বুকে, মাথায় রাখেন হাত।
ছেলেটি ভালো কোম্পানির চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে আগেই। কথা ছিল অপারেশনের পরেই চাকরিতে জয়েনিং, তার পরদিনই বিয়ে। রজনীগন্ধার জেগে থাকা রাতে তাদের গন্ধ বিলাস। একজন দুজন তিনজন…জুঁইয়ের পেটে কান রেখে সে বলবে, শুনছ! এখন তোমার মাকে আমি খুব আদর করব কিন্তু!
অভ্র, উৎসব, অনিরুদ্ধ ছেলেটির ভালো বন্ধু। পায়ে পায়ে ফুটবল হোক আর স্নানে গানে ভেজা সুখ সবেতেই চার জুটি।
জুঁই চলে যাবার পরেই ওরা এসেছে আজ। তোর চাকরিটা যদি আমাদের কাউকে একটা দিয়ে যাস… মানে যাকে তোর উপযুক্ত মনে হবে। প্রয়োজন যার বেশি…
তোর কোম্পানি বলেছে, তোর শেষ ইচ্ছে পূরণ করবেই!
সেলাইনের ব্যথায় হাত বোলাতে বোলাতে ছেলেটি ভাবছে, কার প্রয়োজন বেশি!
বড্ড বেশি মাথায় ব্যথা আজ। ডাক্তার চৌধুরী কেন যে এখনও আসছেন না!
সার্জারি রুমে ছেলেটির মাথা চিরে চিরে ডাক্তার চৌধুরী তাঁর এত বছরের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন, ভিতরের এ টিউমার ভালো হওয়ার নয়। এ ঘা শুকানোর নয়! পুনরায় সেলাই করে দিয়ে উনি বলেছিলেন, তোমার সময় বড় কম। বাড়ি যাবে?
ছেলেটির মা তো জন্ম দিয়েই গেছেন সে অন্য বাড়ি। বৃদ্ধ বাবা বললেন, আমি আর ও নিয়ে কী করব? এখানেই বরং ভালো থাকবে। কখন কী হয়…
ওই তো পাপিয়াটা এসেছে আবার। জানলা দিয়ে ঢুকে ছেলেটির মুখে লেগে থাকা খাবারের টুকরোটা খেয়ে নিল। ছেলেটি বলল, তুই আমার হবি আজ? পাপিয়া ডেকে উঠল, পিউ কাঁহা!
হেই হুশ! দেখ দিকি কোথা থেকে মরা পাখি এসে বুকে বসেছে পেশেন্টের! পাপিয়াকে তাড়িয়ে দিল কর্তব্যরত নার্স।
খুব জোরে ঝড় উঠেছে! ধুলোর ঝড়। চারিদিক অন্ধকার। ছেলেটির মাথার সেলাইগুলো সেই ঝড়ে উড়ে যেতে চাইছে!
নার্স এসে বলল, তোমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে পারি? তোমার এত মনের জোর…
ছেলেটি মুচকি হাসল। নার্সের মোবাইলে যে কদিন থাকে, ওই হাসিটুকুই থাক।
ঝড় থেমে সন্ধে নামল। ছেলেটির চারিদিকে তার চেনা অচেনা মানুষ। কোথাও ধান ক্ষেত নেই, পাপিয়া নেই, আলো নেই…
প্রেমিকা কাঁদছে। বলছে, আমায় ভুল বুঝো না! কোনদিন ভুলব না তোমায়!
বন্ধুরা বলছে, চাকরিটা বল না কাকে দিতে চাস?
ছেলেটির বৃদ্ধ বাবা বলছে, জমানো সব শেষ বাবা!
ছেলেটি খুঁজছে। চারিদিকে চোখের মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজছে।
ডাক্তার চৌধুরী ছেলেটির সেলাইয়ের পাশে হাত রেখে বললেন, কী খুঁজছ?
ছেলেটি শুষ্ক ঠোঁট নেড়ে বলল, অন্তর-বাস।
নার্স দুজন বোধহয় মধ্যের হাইফেন বুঝতে পারেনি। ফিসফিস করে বলে, মরার সময়েও এসব? কী অসভ্য রে বাবা!
ডাক্তার চৌধুরী ছেলেটির চিবুক ছুঁলেন… বললেন,
তোমার আত্মায় তোমায় অন্তর-বাস।
ছেলেটির নিঃশ্বাস পড়ল সন্ধের বুকে।
পাপিয়া ঝড়ের পরেও ঘর খুঁজছে…পিউ কাঁহা!