মুসলিম দরগায় নবান্ন উৎসব পালন হিন্দু সম্প্রদায় মানুষের, রাজনগরে
সেখ রিয়াজুদ্দিন বীরভূম,
মানুষে মানুষে যখন বিভেদ লাগিয়ে বা ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে তখন মানুষকে আরও বিষিয়ে তোলে। সেই সমস্ত বিষয় এড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে নজির স্থাপন করে চলছে রাজনগর। সেরূপ রাজনগরে এক মুসলিম দরগায় নবান্ন উৎসব পালন করলেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন। জানা যায় প্রতি বছরের মতো এবারও রাজনগরের কাদাকুলি গ্রাম সংলগ্ন মীর সাহেবের দরগাহ শরীফে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে এবং প্রথা মেনে পহেলা অগ্রহায়ণ এখানে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে।এবছরও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। নতুন ধানের অন্ন যাহা ‘নবান্ন’ । প্রাচীন হিন্দু রীতি অনুযায়ী, ধান মাঠের ঈশান কোন থেকে আড়াই মুট ধান কেটে, তাতে গঙ্গাজল-সিঁদুর মাখিয়ে, ধূপ-ধুনো দিয়ে কাপড়ে মুড়ে মাথায় করে, পায়ে হেঁটে বাড়িতে আনা হয়। স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘মুট আনা’ বলা হয়।
সেই মুট বাড়িতে লক্ষ্মীর থানে রেখে পুজো দিয়ে মুটের সেই ধান থেকে মিষ্টান্ন বানানো হয়। সেই মিষ্টান্ন মীর সাহেবের দরগায় নিয়ে গিয়ে প্রসাদ হিসেবে অর্পণ করা হয়।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও এদিন মীর সাহেবের দরগায় এসে চাদর চড়ান ও শিন্নি দেন।
রাজনগরের নিত্যানন্দ দত্ত, উত্তম দত্ত, সাধন সূত্রধর, দীপক দে, মফিজ আলী, ক্বারী আখতার রাজা, শওকত আলীরা একসাথে মিলেমিশে সম্প্রীতির নবান্ন পালন করেন।
রামের সাথে রহিমকে এখানেই মিশতে দেখা গেল।
পহেলা অগ্রহায়ণ মীর সাহেবের দরগা চত্বর এদিন সম্প্রীতির মহামিলন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
রাজনগরের মালিপাড়ার দত্ত পরিবারের সদস্য নিত্যানন্দ দত্ত জানান প্রায় পাঁচশত বছর আগে বিনোদ দত্ত নামে তাদেরই এক পূর্বপুরুষের সময়ই মীর সাহেব কাদাকুলি ও মালিপাড়া গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় আসেন।
মীর সাহেব সুফি সাধক হিসেবে পরিচিত থাকায় সেসময় ওই এলাকার বহু মানুষ তার ভক্ত হয়ে পড়ে। মালিপাড়া গ্রামের বিনোদ দত্ত ও এই সুফি সাধকের ভক্ত হয়ে পড়েন এবং তিনি মীর সাহেবকে সেখানে বেশ কিছু জায়গা দান করেন। জনশ্রুতি, সে সময় মীর সাহেব এলাকার সাধারণ মানুষদের আর্থিক দূরাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রম দিবস তৈরির চিন্তা ভাবনা শুরু করেন, এজন্য এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করতে থাকেন। মীর সাহেব ওই মসজিদ নির্মাণকারী মিস্ত্রি ও কর্মচারীদের বেতন দিতে থাকেন, যা ওই সময়ে রাজার অন্যান্য কর্মচারীদের দেওয়া বেতনের দ্বিগুণ বেতন দিতেন মীর সাহেব। মীর সাহেবের টাকার সূত্র কি? এটা নিয়ে সবাই ধন্ধে ছিলেন রাজা সহ। সন্দেহজনকভাবে রাজা তাকে সে সময় বন্দীও করেন। কিন্তু তারপরেও তার মসজিদ নির্মাণের কাজ থেমে থাকে নি। তিনি তার কর্মচারীদের বেতনও দিতে থাকেন। তার এই অলৌকিক ক্ষমতা দেখে রাজা তাকে মুক্তি দেন। দত্ত পরিবারের বিনোদ দত্তের কাছ থেকে তিনি নিজের সমাধি নির্মাণের জন্য মসজিদের পাশেই একটি ঢিবি জায়গা নেন এবং পরবর্তীতে সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।
এরপর বিনোদ দত্তের ওইখানেই একটি ধান জমি থেকে পায়েসান্ন তৈরি করে তার সমাধিতে অর্পণ করা হয় পয়লা অগ্রহায়ণ এবং তখন থেকেই এখানে নবান্ন উৎসব চলে আসছে বলে জানান নিত্যানন্দ দত্ত।
এই নবান্ন উৎসব ঘিরে এখানে ছোটখাটো একটি মেলা ও আয়োজিত হয়ে থাকে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।