বঙ্গ বিজেপির হলোটা কি?,
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,
এখনো এক বছর হয়নি। বাংলায় গত বিধানসভা ভোটে দুই শতাধিক আসন পেয়ে ক্ষমতা দখল করার স্বপ্ন দেখা প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কার্যত নিত্য যাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। সঙ্গে ডজনখানেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতাদের বারবার প্রচার তো ছিলই । ওদিকে তৃণমূল দলে ভোটের আগেই ধ্বস নেমেছিল। দল থেকে সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করে নিম্নমানের অজুহাত দেখিয়ে বেশ কয়েকজন তথাকথিত প্রথম সারির নেতা দল ছেড়েছে। তারা মনে করেছিল বিজেপি এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসছেই এবং তারাও মন্ত্রী হয়ে নিজেদের মৌরসিপাট্টা বজায় রাখতে পারবে। ভোটের ফল বের হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একদল দলত্যাগী পুরনো দল তৃণমূলে ফিরে এল। ফিরে এলেও আপাতত তারা পুরনো মর্যাদা ফিরে পায়নি। অনেকেই ফিরে আসার চেষ্টা করেও এখনো ফিরতে পারার সুযোগ পায়নি। অপেক্ষায় আছে। হয়তো তাদের দলে শুভেন্দুও থাকতে পারে।
বিধানসভা ভোটের পর থেকেই বঙ্গ বিজেপির ছন্নছাড়া ভাব শুরু হয়। পারস্পরিক দোষারোপের পালা চলতে থাকে। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ঘেরাটোপে থাকা নেতাদের কুকথা বলতে সমস্যা না হলেও বিপদের সময় দলীয় কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিতে দিল্লি ছোটাছুটি শুরু করে দিল। এদিকে যাদের নিয়ে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল সেইসব অসহায় কর্মীরা দলীয় নেতাদের উপর ভরসা রাখতে না পেরে ধীরে ধীরে রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরে গেল।
এই পরিস্থিতিতে পারেন ভবানীপুর সহ পাঁচটি আসনে উপনির্বাচন হয় এবং সব ক'টিতেই বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে যে উত্তরবঙ্গে বিজেপি শক্তিশালী হয়ে উঠছিল সেখানকার জনগণও মুখ ঘুরিয়ে নিল। কয়েকদিন আগে দু'টি আসনে উপনির্বাচন হয়। তার মধ্যে একটি আসানসোল লোকসভা আসন এবং সেটি আবার পরপর দু'বার বিজেপির দখলে ছিল। দল গঠন হওয়ার পর আসনটি তৃণমূল কোনোদিনই পায়নি। আসানসোল আসনটি তৃণমূল শুধু প্রথমবারের জন্য দখল করলনা, জয়ের মার্জিন অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ভেঙে দিল এবং সেইসঙ্গে ছন্নছাড়া করে দিল বঙ্গ বিজেপি দলটাকে। বিজেপির কফিনে পোঁতা হলো শেষ পেরেক। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেনা।
বামপন্থী দলগুলোতে ব্যক্তির ভূমিকা নগণ্য। সেখানে দলই শেষ কথা। অন্যদিকে ডানপন্থী দলগুলোতে দলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিরও ভূমিকা থাকে। কোনো কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে 'লার্জার দ্যান পার্টি ইমেজ' গড়ে ওঠে। কিন্তু তৃণমূল থেকে যারা বিজেপিতে গিয়েছিল তাদের নিজস্ব কোনো জনভিত্তি নাই, পুরোপুরি মমতার দয়ায় তারা নেতা-মন্ত্রী হয়েছে। বিগত বিধানসভার ফল সেই প্রমাণই দ্যায়। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা না করে বিধানসভা ভোটে প্রার্থী নির্বাচনের সময় বিজেপি নিজের দীর্ঘদিনের কর্মীদের অবহেলা করে এবং তৃণমূল সহ অন্য দল থেকে আসা কর্মীদের গুরুত্ব দিয়ে মারাত্মক ভুল করে। তারা তো ডোবেই বিজেপিকেও ডুবিয়ে দ্যায়। সেইসঙ্গে শিক্ষা দিয়ে যায় অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে- নিজের দলের দীর্ঘদিনের কর্মীদের অবহেলা করলে দল কিন্তু শেষ হয়ে যাবে।
বিধানসভা ভোটের পর থেকেই বঙ্গ বিজেপি দলের কোন্দল শুরু হয়েছিল। যদিও সেটা সেভাবে বাইরে আসেনি। তবে ধিক্ ধিক্ করে জ্বলছিল। আসানসোল লোকসভা উপনির্বাচনে হারের পর সেই কোন্দল বাইরে আসে এবং নির্লজ্জতার সমস্ত সীমা অতিক্রম করে। পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি প্রকাশ্যে শুরু হয়ে গ্যাছে। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দিতে কেউ এগিয়ে আসছে না।
২০১৯ শের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপি পুরোপুরি ফ্লুকে ১৮ টি আসন পেয়েছিল। মূলত তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ অংশের সঙ্গে বাম ভোট তারা পেয়েছিল। সুযোগ পেয়েও সংগঠন গড়ে তোলার দিকে নজর দ্যায়নি। নির্ভর করেছিল মোদির জনপ্রিয়তার উপর। প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হিসাবে মোদি সত্যিই কতটা জনপ্রিয় সেটা বিবেচনা করেনি। কতকগুলি রাজ্যে একক ক্ষমতায় এবং কতকগুলি রাজ্যে দল ভাঙিয়ে বিজেপি ক্ষমতা দখল করেছে সেটাও তারা বিবেচনায় আনেনি। প্রকৃত উন্নয়নের পরিবর্তে ফাঁকা বুলি এবং জাতপাতের উপর নির্ভর করে তারা জেতার চেষ্টা করেছে। তাইতো শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলোর কাছে মোদির তথাকথিত জনপ্রিয়তা বারবার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। বঙ্গ বিজেপির নাই কোনো নেতা, নাই কোনো সংগঠন। তাইতো ২০২১ সালের পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই এই বঙ্গে বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়ছে। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে একই ফল অপেক্ষা করছে। তৃণমূলের সন্ত্রাস বলে বেশিদিন টেঁকা যাবেনা। উল্টো দিকে আছে বারবার সিপিএমের সন্ত্রাসের শিকার হওয়া কিন্তু রাজনীতির ময়দান ছেড়ে না যাওয়া মমতা ব্যানার্জ্জী। এখনো সময় আছে। সতর্ক না হলে বঙ্গ বিজেপিও কংগ্রেসের মত সাইন বোর্ড সর্বস্ব হয়ে যাবে। পরিস্থিতি সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।