পুর নির্বাচন ও গুসকরায় তৃণমূলের সম্ভাবনা,
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,
উন্নয়ন এবং নিয়মিত জনসংযোগ যদি নির্বাচনে জয়লাভের একমাত্র মাপকাঠি হয় তাহলে গুসকরা পৌরসভার নির্বাচনে বিরোধীদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে আছে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের মত স্হানীয় ভোটের ফলাফল শুধুমাত্র উন্নয়ন বা জনসংযোগের উপর নির্ভর করেনা। বেশ কিছু ছোটখাটো ফ্যাক্টর অনেক সময় এইসব ভোটে বড় প্রভাব ফেলে।
পরপর দু'বার পুরবোর্ড গঠন করলেও বিগত লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে প্রধান বিরোধীদল বিজেপির থেকে তৃণমূল কংগ্রেস অনেক পেছিয়ে আছে। এটা ঠিকই লোকসভা ভোটের থেকে পেছিয়ে থাকার মার্জিন বিধানসভা ভোটে অনেকটা কমলেও এবং সাতটি ওয়ার্ডে বিজেপির থেকে এগিয়ে থাকলেও এখনো খুব একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় শাসকদল নাই।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে গুসকরা পৌরসভায় তৃণমূলের বিপর্যয় ঘটার পর অধিকাংশ তৃণমূল নেতা কার্যত ঘরে ঢুকে যায়। গোটা শহর জুড়ে বিজেপি কর্মীদের দাপট দেখা যায়। তাদের দাপটে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা দিশেহারা। যদিও পরবর্তীকালে পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে আনতে বিজেপি নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়। তৃণমূল শহর সভাপতি কুশল মুখার্জ্জীর সুযোগ্য নেতৃত্বে কিছু তৃণমূল অন্ত প্রাণ নেতা-কর্মী নিয়মিত শহরের দলীয় কার্যালয়ে এবং মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে। পাশে থেকেছে স্হানীয় বিধায়ক অভেদানন্দ থাণ্ডার ও দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা অনুব্রত মণ্ডলের বরাভয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বিধানসভা ভোটে সুফলও পাওয়া গেছে।
রাজ্যে পরপর দু'বার সরকার গঠনের মত গুসকরা পুরসভাতেও তৃণমূল দু'বার বোর্ড গঠন করে। প্রথমবারের বোর্ড গঠন অবশ্য রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতালাভের আগেই হয়েছিল। প্রথম বারের বোর্ড গঠনের প্রধান কারিগর তথা তৎকালীন পুর-চেয়ারম্যান এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা চঞ্চল গড়াইকে দল থেকে বহিষ্কার করা ও পরে গ্রেপ্তারের ব্যাপারটা গুসকরার সাধারণ মানুষ ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি। দলের জন্মলগ্ন থেকে দলের সঙ্গে যুক্ত দুর্দিনের কর্মীদের, এমনকি ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পরেও যারা মাটি কামড়ে পড়েছিল, ধীরে ধীরে কোণঠাসা করা, এবং সিপিএমের কর্মীদের সামনের সারিতে আনা, একশ্রেণী নেতার উদ্ধত আচরণ ও কাটমানি খাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি ঘটনা এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে তার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও আর এক জনপ্রিয় নেত্রী ও চারবারের কাউন্সিলর মল্লিকা চোংদারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে কিনা সেটা আদৌ স্পষ্ট নয়। অথচ প্রমাণ ছাড়াই বলা হচ্ছে - ও নাকি দলের কেউ নয়। কিন্তু চঞ্চল গড়াই বা মল্লিকাদের বিকল্প এখনো পাওয়া যায়নি। বর্তমানে গুসকরায় বিরোধীদের অস্তিত্ব প্রায় শূন্য হলেও এইসব ঘটনার জন্য তৃণমূলও খুব ভাল অবস্থায় নাই।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে ভাল ফল করার পর বিজেপি গুসকরাতে আপারহ্যাণ্ড পেলেও যোগ্য নেতার অভাবে পরিস্থিতির সদব্যবহার করতে পারেনি। বিধানসভা ভোটের পর উল্টে অনেকেই পুরনো দল তৃণমূলে পুনরায় যোগ দেয়। একটানা চৌত্রিশ বছর রাজত্ব করা সিপিএমের অবস্থা তো আরও খারাপ। একমাত্র সমাজ মাধ্যমে বা মাঝে মাঝে সাংবাদিকদের কাছে মমতা বিরোধী মন্তব্যের মাধ্যমে জানা যায় সিপিএম বলে একটা দল ছিল বা আছে। কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। অস্বীকার করার উপায় নাই, কমে গেলেও, এখনো দুটি দলেরই কিছু ভোটার আছে। এগুলো কিন্তু ভোটে ডিসাইডিং ফ্যাক্টর হতে পারে।
রায়-চ্যাটার্জ্জী জুটির বিরুদ্ধে বা মেলবন্ধন সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও বর্তমান প্রশাসক মণ্ডলীর বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত দুর্নীতির জোরালো অভিযোগ ওঠেনি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমান প্রশাসকমণ্ডলী যথেষ্ট কাজও করেছে। আগের থেকে রাস্তাঘাট উন্নত। রাস্তার খারাপ বাতিগুলো বদলানো হয়েছে। বেশ কিছু বৈদ্যুতিক খুঁটিতে রঙিন এল.ই.ডি লাগানো হয়েছে। নিকাশী ব্যবস্থারও উন্নত হচ্ছে। এলাকাবাসীর দাবী মেনে সম্প্রতি শিশুদের জন্য একটি পার্কও চালু করা হয়েছে। গুসকরা পুর এলাকা ছাড়াও আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ গুসকরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য এলেও পরিকাঠামোর দিক দিয়ে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। যদিও সম্প্রতি বিধায়ক দাবী করেছেন স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির উন্নতির জন্য কুড়ি কোটি টাকার দাবি সম্বলিত একটি আবেদন পত্র স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রতিমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। তারপরও পুরভোটে তৃণমূলের জয় নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।
পুরসভার মত স্হানীয় ভোটে দলীয় প্রতীকের থেকেও বেশি জরুরি প্রার্থীর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। এটা ঠিকই অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য দলীয় প্রার্থী জয়লাভ করলেও জয়ী নির্দল প্রার্থীর সংখ্যা কম নয়। দরকার যেসব নেতা-নেত্রীরা সারাবছর মানুষের পাশে থাকে তাদের থেকে প্রার্থী নির্বাচন করা। কিন্তু যেভাবে বিভিন্ন ওয়ার্ড সভাপতি বদল করা হয়েছে সেটা কিন্তু অনেকেই ভালভাবে মেনে নেয়নি। তাদের বক্তব্য সেক্ষেত্রে আগে ব্লক স্তরের নেতৃত্বে বদল আনতে হতো। এছাড়াও একটা সময় যারা শহর সভাপতির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে গেছে তাদের এখন খুব একটা সক্রিয়ভাবে দেখা যাচ্ছেনা। নতুনদের নিশ্চয়ই সুযোগ দিতে হবে কিন্তু তার জন্য পুরনোদের অবহেলা করার কোনো দরকার নাই।
স্হানীয় ভোটে নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা একটা বড় ফ্যাক্টর। ভদ্র আচরণ এবং আপদে-বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সর্বস্তরের মানুষের ও নেতা-কর্মীদের কাছে বর্তমান শহর সভাপতি কুশল মুখার্জ্জীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও পূর্বসুরী চঞ্চল গড়াই বা মল্লিকা চোংদারদের থেকে জনপ্রিয়তায় তিনি অনেক পেছিয়ে আছেন। যদিও জনপ্রিয়তা সবসময় জয়ের একমাত্র মাপকাঠি নয়।
আপাতত বিরোধীদের ছন্নছাড়া ভাবের জন্য পুরভোটে জয়ের ব্যাপারে তৃণমূল নিশ্চিত থাকলেও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতাহীন কয়েকজন নেতা-কর্মীর উপস্থিতি এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে এবং তৃণমূলের জয়ের ব্যাপারে প্রশ্ন চিহ্ন তুলে দিচ্ছে। প্রার্থী হিসাবে বিধায়কের নাম ঘোষণা নতুন গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের জন্ম দিতে পারে। বিভিন্ন ওয়ার্ডে কান পাতলেই পরিস্থিতি উপলব্ধি করা যায়। মূলত এই জন্যেই গুসকরা পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে সাপ-লুডো খেলা চলতে থাকে। কখনো মনে হয় তৃণমূল পুরভোটে ওয়াক ওভার পেয়ে গেছে। আবার কখনো মনে হয় এবার হয়তো আর তৃণমূলের পুরভোট গঠন করা হবেনা।
এখনো পুরভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়নি। আরও কিছু দলবদল ঘটতে পারে। তাতে বিরোধী শক্তি আরও দুর্বল হবে। এতে যদি তৃণমূল মনে করে ফাঁকা মাঠে গোল করব তাহলে মারাত্মক ভুল করবে। মনে রাখতে হবে তৃণমূলের বড় শত্রু তৃণমূল নিজেই।