পাত্রসায়েরের ঘোষবাড়ির ঐতিহ্যবাহী কালিপুজো
ছোটন ঘোষ,
; মল্লরাজার আমল থেকেই বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়ের থানার অধীন খোসালপুর গ্রামের সদগোপ বাড়ির বিখ্যাত মা কালীর পুজো আজও তার নিজস্ব ঐতিহ্য বজায় রেখে চলছে । এই পুজো তিনশো বছরেরও প্রাচীন।এই বনেদি বাড়ির পুজোয় তাদের নিয়মনিষ্ঠা, ভক্তি, উন্মাদনা এবং জাঁকজমক আজও বর্তমান।এই পুজো নিয়ে আশেপাশের অঞ্চলের মানুষদের তীব্র আগ্রহ থাকে। তারই রেশ ধরে দূরদূরান্তের মানুষজন দেখতে আসেন সাবেকিয়ানা ও আধুনিকতার মেলবন্ধনের এই কালিপুজো।ঘোষ বংশের প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই কৃষ্ণকান্ত ঘোষ ও পরান ঘোষ বর্গীদের আক্রমণ ও লুটপাটের প্রতিবাদে কঠিন লড়াই করে রণক্লান্ত, শ্রান্ত এবং আহত শরীরে হুগলির সেনাই অঞ্চলের ভিটে পরিত্যাগ করে খোসালপুরে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন একদা।পরিবারের তরফে শ্রী অসিত ঘোষ জানান, -” ভোর রাত্রে মন্দির সংলগ্ন পবিত্র কালিবাঁধ পুষ্করিনির মধ্যস্থল থেকে মাকালী শাঁখা পলা পরিহিতা কৃষ্ণবর্ণের হাত দুখানি তুলে দেখা দিতেন পরান ঘোষের স্ত্রী কে। স্বপ্নাদেশ এ তাকে প্রতিষ্ঠা করার কথা জানাতেন। সেই মতো মা কে বেনেডাঙ্গা নামক স্থানে (যেখানে আগে বেনিয়ারা বসবাস করতেন) প্রতিষ্ঠা করা হয়।সেখানে মা এর পবিত্রতা রক্ষা করা হতো না। বেনেদের হাতে মা প্রতিদিন অপবিত্র হতেন। মা এর রোষানলে পরে বেনেরা। মা এর ইচ্ছামতো বেনে পরিবারের এক কৃষ্ণবর্ণের কিশোর নিজহস্তে মা এর খড়গ নিজের গলায় নিয়ে শিরশ্ছেদ করে। নরবলির পরই বেনিয়া সম্প্রদায় ভয়ে খসালপুর পরিত্যাগ করে”। ঘোষ পরিবারও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মা এর পুজো বন্ধ করে দেয়।মা স্বপ্নাদেশ এ অভয় দেন যে তার নরবলির ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। ঘোষ পরিবারের কোনো অনিষ্ট হবে না। যেভাবে খুশি সেভাবেই যেনো তারা পুজো করে, শুধু এঁটো কাঁটা যেনো মা কে নিবেদন না করা হয়। মা এর আশির্বাদ বর্ষিত হবে ঘোষ পরিবারের ওপর, কোনোদিন কারোর অভাব হবে না। মা স্বয়ং কিশোরীর বেশে গিয়ে মূর্তি গড়ার কারিগর কে বলে আসেন, মূর্তির মাপজক সব নির্দেশ দিয়ে আসেন। একই ভাবে বাদ্যকার, কুমোর, কামার ইত্যাদি সবকিছুর বন্দোবস্ত করে দেন।এখনও পুজোর সময় সব সম্প্রদায় এসে হাজির হয়ে যান। কাউকেই কোনোদিন আমন্ত্রণ জানানো হয় না। বংশানুক্রমে এই প্রথা চলে আসছে।মা এর আশীর্বাদে খোসালপুরের সম্ভ্রান্ত কৃষক, সরকারী- বেসরকারি চাকুরিজীবি, অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী।মা এর নামে রাখা প্রচুর সম্পত্তি এই কালীপুজো কে মহা আড়ম্বরপূর্ণ করে রাখে।পাঁচ দিন ধরে চলে এই পুজো। আরামবাগ দলের যাত্রা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, বাউল, লোকগীতি, কবিগান ইত্যাদি অনুষ্ঠান এই পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তবে সাম্প্রতিক কালের মহামারী প্রকোপ এর কথা মাথায় রেখে গত বছর থেকে অনুষ্ঠান বন্ধ করা আছে। নরবলি বন্ধ হলেও পাঁঠা বলি, চালকুমড়া বলি ও আখ বলি এখনও চলে আসছে। মুড়কি, নারকেল খই সিড়ি নাড়ু প্রতিটি বাড়িতেই তৈরি হয়। হেমন্তের ঘোর অমাবস্যায় রাত্রি দশটায় পুজো শুরু হয়।এই পুজোর দায়িত্বে থাকা শ্রী অসীম ঘোষ ও প্রণব ঘোষ জানান মা ভীষণ জাগ্রত। ভক্তি ভোরে পুজো দিলে মা ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন।বেশ কয়েক বছর আগে মা এর গয়না চুরি করতে এসে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা সবার মুখে শোনা যায়।পুজো কমিটির কোষাধক্ষ্য এবং পেশায় পঞ্চায়েত আধিকারিক শ্রী নবরূপ ঘোষ জানান,-” মা এর নির্দেশে পুজোর পাঁচদিন কাউকে না খাইয়ে, খাদ্যদ্রব্য না দিয়ে ফেরানো হয় না। মা এর ইচ্ছেমতো কালিবাঁধে বিসর্জন সম্পন্ন হয়।মায়ের মাহাত্ম্যে এই পুষ্করিনীর জল কখনো শুষ্ক বা দূষিত হয় না। এই পুকুরের জল ভীষণ পবিত্র মনে করা হয়। মাএর সুদৃশ্য মন্দির, মন্দিরের সামনে কংক্রিটেরবাঁধানো বিশাল প্রাঙ্গণ, অতিথিশালা, নাটমন্দির, বৈঠকখানা বর্তমান।পুজোর দিনগুলো গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে মোমবাতির আলোয় আলোকিত করা হয়।তাই এবার যদি আপনার গ্রামবাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত পুজো দেখার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে অবশ্যই আসুন খসালপুরের এই বিখ্যাত ব্যতিক্রমধর্মী বনেদি বাড়ির কালীপুজোতে”। এখানে পুজোর জৌলুস, আন্তরিকতা ও আপ্যায়ন আপনাকে মুগ্ধ করবেই। পাত্রসায়ের থানার কাঁকড়ডাঙ্গা মোড় থেকে কিছু দূরের গ্রামের পথ দিয়ে এই ঘোষ বাড়ি।
তথ্যসূত্র: প্রফেসর (ডা:) ছোটন ঘোষ, মেডিসিন বিভাগ, প: ব: প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা