Spread the love

নতুন গতির ঈদ সংখ্যা প্রকাশ ও ঈদ মিলন অনুষ্ঠান পালিত হল মহা সাড়ম্বরে


নিজস্ব প্রতিনিধি
গত ১৫ অক্টোবর আলিয়া ইউনিভার্সিটির পার্ক সার্কাস ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে সাড়ম্বরে পালিত হল নতুন গতি পত্রিকার ঈদ মিলন অনুষ্ঠান এবং ঈদ সংখ্যার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ৷ চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়৷ কোরআন শরীফ পাঠ করেন সেখ মহম্মদ আজহারউদ্দিন৷ এরপর পুষ্পস্তবক দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয় নতুন গতির পক্ষ থেকে৷ উদবোধনী সংগীত পরিবেশন করেন ড. মনীষা চক্রবর্তী৷
এই অনুষ্ঠানে প্রারম্ভিক ভাষণ দেন বিশিষ্ট কবি ও সম্পাদক আবু রাইহান৷ তিনি বলেন, ১৮ বছর ধরে অনুষ্ঠান করে নিয়মিত একটি ঈদ সংখ্যার প্রকাশ সত্যিহৈ বিস্ময়ের! দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে নতুন গতি পত্রিকাকে সম্পাদক এমদাদুল হক নূর আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছেন৷ পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নতুন গতি এত বছর ধরে কাজ করছে—এটা কম বড় কথা নয়৷ ধারাবাহিকভাবে ‘মাসান্তিক’ পত্রিকার প্রকাশও খুব সহজ বিষয় নয়৷ এই কঠিন কাজটি করে চলেছেন এমদাদুল হক নূর, এটা আমাদের সমাজের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়৷ পড়াশোনা-লেখালেখি একটি দীর্ঘ অনুশীলনের বিষয়৷ যাঁরা লিখেছেন, এই চর্চা নিয়মিত না করলে লেখালেখির ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেয়৷ নতুন গতি লেখক-পাঠককে সারা বছর ধরে এই চর্চার মধ্যে বেঁধে রাখে৷
প্রারম্ভিক ভাষণের পর ইসলামী সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী পলাশ চৌধুরী৷ এরপর বক্তব্য রাখতে ডায়াসে আসেন কাফেলা যুগের বিশিষ্ট লেখক সেখ হাসান ইমাম৷ তিনি বলেন, আবদুল আজীজ আল-আমানের কাফেলা যুগ থেকেই এমদাদুল হক নূরের সঙ্গে আমার সখ্যতা৷ তিনি আমার ছোট ভাইয়ের মতো৷ সেই আশির দশকের পর থেকে যে কর্মকাণ্ড তিনি শুরু করেছেন, তা আজও সচল৷
ঈদ কবে থেকে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হল? এই ইতিহাস আমাদের জানা দরকার৷ আজ যে ঈদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নতুন গতির উদ্যোগে তা দুটি ঈদের মিলিত সম্মেলন৷ উৎসব মানুষের জীবনকে আনন্দময় করে তোলে৷ সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে মানুষকে৷ ইসলামের বিধান অনুযায়ী উৎসব তাই শ্লীলতার মাত্রা অতিক্রম করবে না৷ সেই সত্যকে মাথায় রেখেই আমাদের ঈদের ঐতিহ্য পালন করতে হবে৷ নতুন গতির ঈদ সংখ্যা প্রকাশের এই ঘরোয়া এবং মহৎ অনুষ্ঠান আমাদের ভেদাভেদ দূর করার বার্তা দিচ্ছে৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঊধের্ব উঠে মানুষের মাঝে মিলনের সেতু গড়ার কান্ডারী এমদাদুল হক নূর দীর্ঘদিন ধরেই সেই পথকে প্রসারিত করছেন৷
এরপর ২০২৩ সালের ঈদ সংখ্যাটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. সৈয়দ নুরুস সালাম৷ ঈদ সংখ্যা প্রকাশের পর তিনি বলেন, আমার দীর্ঘ পাঠ থেকে বলতে পারি ‘নতুন গতি মাসান্তিক’ই হল মুসলিম সমাজের প্রকৃত দর্পণ, যে পত্রিকা উৎকৃষ্ট লেখা ছেপে আমাদের সমাজকে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নের পাঠ দিচ্ছে৷ তাই নতুন গতিকে উৎসাহ দেওয়া, তাকে সহযোগিতা করা আমাদের দায়৷ মোস্তাক হোসেন সাহেব একদিকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন৷ আর নতুন গতি উৎকৃষ্ট সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে মেধার-মননের বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে৷ এমন সুন্দর অনুষ্ঠান করার জন্য নতুন গতি পত্রিকা কর্তৃপক্ষ এবং এমদাদুল হক নূরকে ধন্যবাদ জানাই৷
ঈদ সংখ্যা প্রকাশের মঞ্চেই এদিন প্রকাশ পেল বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক এবং প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক মহিউদ্দিন সরকারের ‘ইসলামের পরিচয়’ গ্রন্থটি৷ এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের সভাপতি ড. কুমারেশ চক্রবর্তী৷
এরপর আবার সংগীত৷ পরিবেশন করেন ড. দীপা দাস৷ নতুন গতি পত্রিকার সম্পাদক তথা প্রাণপুরুষ এমদাদুল হক নূর বলেন, মুসলিম সমাজে কোয়ালিটি এডুকেশন বাড়ছে, এটা অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই৷ কিন্তু আমাদের সমাজে কোয়ালিটি সংস্কৃতি বাড়ছে না৷ এটা না বাড়লে এই জাতির কোনো ভবিষ্যত নেই৷ জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন আমরা ব্রিটিশদের ইতিহাস নেব না৷ ভারতের সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন রোমিলা থাপার, হরবংশ মুখিয়ার মতো ইতিহাসবিদ৷ বর্তমানে ইতিহাস এবং টেকনোলজি নিয়ে লড়াই চলছে৷ এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে কোয়ালিটি সংস্কৃতিচর্চা অত্যন্ত জরুরি৷ যা মানুষের কাজে লাগে তাতেই পুণ্য আছে৷ আমাদের আক্ষেপ বিদ্রোহীর শতবর্ষ নিয়ে কোনো বড় কাজ হল না এই বাংলায়৷ অথচ মুসলিম সমাজ থেকেই এটা হওয়া উচিত ছিল৷ তাই অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, নিজেদের চেষ্টা করতে হবে৷
হুগলির হাজী মহম্মদ মহসীন কলেজের অধ্যাপক ড. প্রবাল সেনগুপ্ত বলেন, বাংলাভাষার উৎপত্তির যুগ থেকেই হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম এবং খ্রিস্টানদেরও সমান অবদান আছে৷ ফলে যে ভুল ইতিহাস আমাদের পড়ানো হয়, তা দূর করার জন্য আমাদেরই চেষ্টা করতে হবে৷ ১৯১১ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের অঙ্গনে মুসলিমরা নিজেদের ছাপ রাখতে শুরু করলেন৷ এরই পাশাপাশি মুসলিম সাহিত্য সমিতির পত্রিকায় লিখেছেন তখনকার দিনের দিকপাল হিন্দু লেখকরাও৷ ‘সওগাত’ পত্রিকার মহম্মদ নাসিরউদ্দিন সাহেব সাহিত্যের বহুমুখী দিক খুলে দিয়েছিলেন৷ তিনি কোনো ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না৷ তাই রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়—সবাই লিখেছেন এই পত্রিকায়৷ অন্যদিকে নারীদের জন্য সৈয়দ নাসিরউদ্দিন অন্য দিগন্ত খুলে দিয়েছিলেন, যা এক ইতিহাস৷ নতুন গতি এই ধারারই বাহক৷ আগামীতে এই পত্রিকা এগিয়ে যাবে আরও, এই কামনা করি৷
উত্তর চবিবশ পরগনা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ এ.কে.এম. ফারহাদ বলেন, আজকে আমি মূলত শোনার জন্যই এসেছিলাম৷ সেখানে এসে বলতে হবে আমি ভাবিনি৷ যা শুনলাম সমৃদ্ধ হলাম৷ নতুন গতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের সূত্রে বলতে পারি, নতুন গতি আমাদের কেবল দিয়েই গেছে৷ তার বিনিময়ে কি আমরা কিছু দিতে পেরেছি! সমাজে সাহিত্যচর্চার আলো এনেছে নতুন গতি৷ সেই আলোতে পথ চলছি আমরা৷ নতুন গতি সেই সাহিত্যের মশাল নিয়ে এগিয়ে চলুক৷ আর সেই আলোয় আলোকিত হোক সমাজ, মানুষ, সাহিত্য-সংস্কৃতি৷
ঈদ সংখ্যা প্রকাশের এই অনুষ্ঠানে এদিন সংবর্ধিত করা হয় তিনজন বিশিষ্ট কবিকে৷ তাঁরা হলেন কেতকী মির্জা, এম আলাউদ্দিন খান এবং সাকিল আহমেদ৷ তাঁদের মানপত্রগুলি পাঠ করেন নতুন গতি পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক মনিরা খাতুন৷
এরপর বক্তব্য রাখেন ড. মীরাতুন নাহার৷ তিনি বলেন, দেশভাগের পর বাঙালি মুসলিম সমাজে একটা আকাল দেখা দেয়৷ ৭৪ বছর ধরে মুসলমান সমাজে একটা লড়াই চলছে ধীরে ধীরে৷ সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতিচর্চায় একটু একটু করে এগিয়ে এসেছে তারা৷ ঈদ সংখ্যা প্রকাশের অনুষ্ঠান হল মিলনের অনুষ্ঠান৷ হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে এখন সবাই বিচ্ছিন্ন থাকতে চায়৷ তবু মুসলমান সমাজে সাহিত্যচর্চা বাড়ছে না বলে আক্ষেপ করার কোনো কারণ নেই, কেননা এই সমজের কাছে ইহকালের চেয়ে পরকালের গুরুত্ব অনেক বেশি বলেই মনে হয়৷ যেদিন বাস্তবতা বুঝবে মুসলমানরা, সেদিন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে তারা৷ এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আর বই পড়ছে না, তারা প্রযুক্তির মধ্যে বুঁদ হয়ে আছে৷ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স তাদের মনের দখল নিয়েছে, ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে বলা মুসলিম৷ তাই বদল মেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে৷
এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কবি এবং অধ্যাপক ড. কুতুবউদ্দিন বিশ্বাসের ‘বাংলা ইসলামী কবিতা’র বইটির মোড়ক উন্মোচন হয়৷ এরপর আবার বক্তব্যের পালা৷ এবার বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট লেখক আলিমুজ্জমান৷ তিনি বলেন, নতুন গতির সম্পাদক এমদাদুল হক নূর রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন তার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই৷ এভাবেই নতুন গতি এগিয়ে চলুক আগামীর পথে৷
চিন্তাবিদ মহিউদ্দিন সরকার বলেন, সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ রাববুল আলামীনের৷ আমার যে গবেষণামূলক গ্রন্থটি আজ এই মঞ্চে প্রকাশ পেল তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি নতুন গতির সম্পাদক এমদাদুল হক নূরকে৷ বাঙালি জাতির কাছে ইসলামের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন ইসলামি ফাউন্ডেশন তৈরির মাধ্যমে৷ কিন্তু সে-ও অনেক আগের কথা৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে নতুন গতি তাকে কুর্নিশ জানাই৷ সবাই ভালো থাকবেন৷ ধন্যবাদ৷
কেজিএন মার্বেল-এর কর্ণধার তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী সিরাজুল হক বলেন, এমদাদুল হক নূর দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে জাতির উন্নয়নের জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা এককথায় অনন্য৷ এইভাবে এত দীর্ঘ সময় ধরে একটা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা সত্যিই বিস্ময়কর! জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এত মানুষকে নিয়ে সমন্বয় সাধনের কাজ করে এমদাদুল হক নূর নিজেকেই ছাপিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
দীর্ঘ অনুষ্ঠানের পর এবার একটু ভিন্ন স্বাদ৷ সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী মধুবন চক্রবর্তী৷ তারপর আবার বক্তব্য রাখেন আবদুর রউফ৷ তিনি বলেন, নতুন গতির ঈদ সংখ্যা প্রকাশের অনুষ্ঠান এবার একটু বিলম্বে প্রকাশ পেল৷ আসলে এই সংখ্যা বের করার পিছনে যে কষ্টসাধ্য ব্যাপার থাকে সেটাকে মান্যতা দিতেই হবে৷ তাই এমদাদুল হক নূরের এই ঐকান্তিক প্রয়াসকে সংবর্ধনা জানাতেই হয়৷ এমদাদুল হক নূর না থাকলে আমাদের মতো মানুষ সাহিত্যিক হিসাবে কোনো প্ল্যাটফর্ম পেতাম না৷ সাহিত্যিক হিসাবে আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠা থাকত না৷ তাঁকে অন্তরের অকুস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই৷
সবার শেষে সভাপতির ভাষণে ড. কুমারেশ চক্রবর্তী বলেন, ৭০ সাল থেকেই এই ধরনের অনুষ্ঠানে আসতে আসতে আপনাদের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছি৷ আমাদের উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ সমাজ৷ কিন্তু আমার পরিবার এতটাই উদার ছিল যে বিশ্বনবীর বাণীকে তুলে ধরতে আমার কোনোদিন কোনো অসুবিধা হয়নি৷ তাঁর জীবনকে উপলব্ধি করতে আমার সমস্যা হয়নি৷ বরং বিশ্বনবীর জীবন আমাকে ভীষণভাবে টানে৷ কারণ, তাঁর জীবনাচরণ, তাঁর সাম্যবাদ, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা, মানবাধিকার নিয়ে পদক্ষেপ আজও অমর হয়ে আছে৷ তাই মহানবীর উদারতাকে ধারণ করে আমাদের এগোতে হবে৷ সারা বছর ধরে এমদাদুল হক নূর এত সংখ্যা বার করেন যা সত্যিই অতুলনীয়৷ এবং সবচেয়ে বড় কথা এমদাদ উৎকৃষ্ট সাহিত্যের উপর জোর দেন৷
এদিনের অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি সামিমা মল্লিক, সালেহা খাতুন, সাকিল আহমেদ, আলমগীর রাহমান, মনিরা খাতুন, এম. আলাউদ্দিন খান, ইনাস উদ্দিন, আসাদ আলী প্রমুখ৷ এছাড়াও নিজস্ব একটি লেখা পাঠ করেন ড. সেখ কামালউদ্দিন৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *