এবার কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি?
জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী
২০২০ সালের জানুয়ারি মাস। ততদিনে চীনের সীমানা অতিক্রম করে করোনা 'পাখি' ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডানা মিলতে শুরু করে দিয়েছে। পরের অভিমুখ ছিল ভারত। লণ্ডন ফেরত যুবকের হাত ধরে বাংলাতেও হানা দেয় করোনা। তার আগেই অবশ্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে করোনার সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলার যুবকটির দুর্ভাগ্য নেটিজেনদের চূড়ান্ত 'ট্রোল'-এর স্বীকার হতে হলো তাকে। ভাবখানা এমন যেন সেই করোনা বিস্তারের জন্য একমাত্র দায়ী। এরপর বাংলায় সবচেয়ে বেশি 'ট্রোল'-এর শিকার হতে হয় শিক্ষক সমাজকে।
২০২০ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সবে শুরু হয়েছে। করোনা আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে শুরু হয়ে গেছে লকডাউন। তখনও এই রাজ্যে পরীক্ষা চলছে। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে রাজ্য সরকারও বাধ্য হয় লকডাউন ঘোষণা করতে। মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় পরীক্ষা। যদিও পরীক্ষা জনিত কারণে আগেই বন্ধ হয়ে যায় পঞ্চম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির পাঠদান। এগুলো ২০২০ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। কার্যত সেই সময় থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পাঠদান বন্ধ আছে।
পাঠদান বন্ধ থাকলেও ছাত্রছাত্রীদের মিড ডে মিল দেওয়া, কন্যাশ্রী সহ ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে এবং বেশ কিছু অফিসিয়াল কাজের জন্য প্রধান শিক্ষক, অন্যান্য শিক্ষক ও করণিকদের প্রায় নিয়মিত বিদ্যালয়ে হাজির হতে হয়। করোনা আবহে প্রথম বছর সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হয় দূরের শিক্ষকদের। একে গণপরিবহন বন্ধ তার উপর সেই পরিস্থিতিতে বাড়ির মালিকরা অন্য জেলা থেকে আগত শিক্ষকদের নিজ নিজ বাড়িতে থাকতে দিতে আপত্তি জানায়। যেখানে করোনার আতঙ্কে সাধারণ মানুষ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেনা সেখানে সরকারি নির্দেশে বহু কষ্টে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ে হাজির হতে হয়েছে। মিড ডে মিল বিতরণ করতে হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে অনলাইনে পাঠদানও করতে হয়েছে।
ততদিনে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হলেও বঞ্চিত থেকে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। তার মাঝেও কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে ২০২১ এর শুরুর দিকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরু হলেও ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি আশানুরূপ ছিলনা। করোনা বেড়ে যাওয়ায় সর্বভারতীয় পর্ষদগুলোর সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে এরাজ্যেও ২০২১ এর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। এমনকি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া হয়। এটা শুধু এই রাজ্যের বিষয় নয়, গোটা দেশেই একই ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
২০২১ এর শেষের দিকে আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়। উপস্থিতির হার নগণ্য দেখে কখনো বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কখনো বা প্রশাসনিক আধিকারিকরা ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য দুয়ারে দুয়ারে হাজির হয়েছে। ফল পাওয়ার আগে আবার করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি এবং ফলস্বরূপ আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর মাঝে ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করতে গিয়ে উড়িষ্যা সহ একাধিক রাজ্য সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের তিরস্কারের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
করোনা আবহে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার ব্যাপারে শিক্ষক সমাজের কোনো ভূমিকা না থাকলেও দিনের শেষে বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে ট্রোলের শিকার হতে হচ্ছে শিক্ষক সমাজকে। এটা কখনোই অস্বীকার করা যাবেনা যে অনেক শিক্ষক ফাঁকিবাজ। ঠিকমত পরীক্ষার খাতা দেখেননা বা 'ক্লাস' করেননা। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে পড়তে না গেলে প্রোজেক্ট বা প্র্যাকটিক্যালে নম্বর না দেওয়ার ব্যাপারে কার্যত হুমকি দেওয়া হয়। তাছাড়া কোন পেশায় ফাঁকিবাজ নাই? এক শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর ফাঁকির বিষয়টি মানুষ তার নিজেদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে টের পেয়েছে। 'দুয়ারে সরকার' প্রকল্পের লাইনে ভিড় দেখে ফাঁকির বিষয়টি ভালভাবেই টের পাওয়া যায় । এটা ঠিকই শিক্ষকতার সঙ্গে অন্য পেশাকে এক প্লাটফর্মে আনা ঠিক নয়। মূলত শিক্ষকরাই সমস্ত পেশার মানুষকে তৈরি করেন।
অনেকের বক্তব্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হলে শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা চাকরি চাইবে, সরকারকে প্রশ্ন করবে। কোনো সরকারই নাকি সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চায়না। করোনার প্রভাবে মাত্র দু'বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তার আগে যারা শিক্ষিত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকে কি চাকরি পেয়েছে অথবা সরকারের কাছে প্রশ্ন করেছে? স্বাধীনতার পর থেকে যদি এত প্রশ্ন করা হয়ে থাকে তাহলে দেশে দূর্নীতি বা বেকার সংখ্যা বাড়ছে কেন? তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সমস্যাটা শুধু এই রাজ্যের বা এই দেশের নয়, সমগ্র পৃথিবীর। তার পরেও শুধুমাত্র এই রাজ্যের শিক্ষক সমাজকে টার্গেট করা হচ্ছে কেন? তাছাড়া মাথায় রাখতে হবে মেলা, খেলা ইত্যাদির উপরেও অনেকের জীবিকা নির্ভর করে। সেগুলো বন্ধ থাকলে অনেক পরিবার সমস্যায় পড়ে যেতে পারে।
অবশ্যই অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি চালু করার ব্যাপারে সরকারকে সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে। আতঙ্ক দূর করার জন্য প্রথম দরকার ছাত্রছাত্রীদের ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা। যদিও বর্তমানে সেই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। যেখানে সাধারণ মানুষ নুন্যতম স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছেনা সেখানে কি করে আশা করা যায় সুকুমারমতি ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে গিয়ে সচেতনতা মেনে চলবে? অনেক দিন পর বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে তারা আনন্দে মেতে উঠবেই। সেক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছেলেমেয়েরা করোনায় আক্রান্ত হলে তার দায়িত্ব কে নেবে?
বর্ধমানের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন - আমিও চাই অবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হোক। প্রত্যেক শ্রেণির জন্য সপ্তাহে অন্তত দু'দিন করেও ক্লাস হোক। কিন্তু বিদ্যালয়ে এসে ছেলেমেয়েরা করোনায় আক্রান্ত হলে তখন কি হবে? সেক্ষেত্রে সরকারের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠবে। অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সেখানে কখনোই শ্রেণি কক্ষের আনন্দ পাওয়া যায়না। তাছাড়া গ্রামের ছেলেমেয়েদের সমস্যা অনেক। প্রথমত সবার মোবাইল নাই। দ্বিতীয়ত সেখানে নেটওয়ার্কের সমস্যা চরম। আমার মনে হয় রাজনীতির উর্ধে উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করার ব্যাপারে সরকার, বিরোধীপক্ষ, শিক্ষক ও চিকিৎসা মহল একত্রে বসে একটা আলোচনা করুক এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিক। তবে সিদ্ধান্ত যাইহোক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেটা তাড়াতাড়িই যেন হয়।